মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৬৪ : ক্রুসেড যুদ্ধ
ক্রুসেড যুদ্ধের কথা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন,না জানলেও অন্তত শুনে থাকবেন। মুসলিম বিশ্ব এবং খ্রিষ্টান জগতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ একটি বিশাল ঘটনা, যার ফলাফলও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় দুই শ’ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা ক্রুসেড যুদ্ধের কারণ ছিল ইউরোপের পশ্চিমা দেশগুলোর জনসংখ্যা বৃদ্ধি।
এই জনসংখ্যার ফলে পশ্চিমারা অর্থনৈতিক লেনদেন বা আদান প্রদানের জন্যে নতুন নতুন ভূখণ্ড খুঁজে বের করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। অনেকে আবার যুদ্ধের কারণ হিসেবে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে পোপদের প্রতিযোগিতার কথাও উল্লেখ করে থাকেন। পোপ গ্রেগরি সেভেন’ এর সংস্কার কর্মসূচির পর পোপদের প্রভাব বেড়ে যাওয়াকেও ক্রুসেড যুদ্ধ বেধে যাবার কারণ হিসেবে মনে করেন। তবে ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন ক্রুসেড যুদ্ধের মূল কারণ ছিল এশিয়া মাইনরে সেলজুকি তুর্কিদের অগ্রগতি, ইস্তাম্বুলের পতন এবং সেইসাথে বলকানে তাদের প্রবেশ রোধ করা। উল্লেখিত কারণগুলো তো রয়েছেই তবে বাস্তব কারণ ইউরোপীয় দেশগুলোর সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে খুঁজতে হবে।
ক্রুসেডের যুদ্ধে বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের সংমিশ্রণ ছিল। খ্রিষ্টান সেনাদল বা সিপাহিদেরকে যে ক্রুশ কিংবা শূল সরবরাহ করা হয়েছিল এই যুদ্ধে সেই ক্রুশ থেকেই এই যুদ্ধ ক্রুসেডের যুদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিপাহিদেরকেও ক্রুসেডার নামে অভিহিত করা হয়। যাই হোক ক্রুসেডারদের সর্বপ্রথম সেনাদলটি ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের কারণ ছিল অপরিকল্পিত এবং অসংগঠিতভাবে তারা যুদ্ধ করেছিল। এই যুদ্ধে ১০৯৬ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টানদের একটি দল বেলগ্রেডের দিকে যাত্রা করেছিল। তারা পথিমধ্যেই ইহুদিদেরকে হত্যা করে এবং তাদের মালামাল লুট করে। তবে এশিয়া মাইনরে (তুরস্ক) পৌঁছে সেলজুকিদের সাথে হেরে যায় এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা।
এই ঘটনার ফলে খ্রিষ্টানরা পরিকল্পিতভাবে এবং সুসংগঠিতভাবে মুসলিম ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চলের দিকে রওনা হয়। ক্রুসেডারদের সুশৃঙ্খল তাঁবুগুলো চারটি ফৌজে বিভক্ত ছিল। তারা যাত্রা শুরু করে দানিয়ুব, উত্তর ইতালি, ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণাঞ্চল অতিক্রম করে। সেলজুকি সাম্রাজ্য তখন তিনটি ভাগে বিন্যস্ত ছিল এবং খাওয়ারেযম শাহীদের হুমকির মুখে আতঙ্কিত ছিল। এই পরিস্থিতির কারণে ক্রুসেডারদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সহজ হয়েছিল। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এশিয়া মাইনরের শহরগুলো দখল হয়ে যায় এবং ক্রুসেডারগণ লিবাননের ত্রিপলি এবং ফিলিস্তিন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বায়তুল মোকাদ্দাস নির্বিঘ্নে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এভাবেই বায়তুল মোকাদ্দাস এবং সেই সিরিয়া পর্যন্ত ক্রুসেডারদের দখলে চলে যায়। খ্রিষ্টানরা প্রথম দিকে মুসলমানদের সাথে ভীষণ রূঢ় আচরণ করতে থাকে, তবে ধীরে ধীরে তাদের সাথে মিলে মিশে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ক্রুসেড যুদ্ধের প্রথম পর্বেই কেবল খ্রিষ্টানরা বিজয় লাভ করেছিল কিন্তু পরবর্তী আটটি যুদ্ধে তারা আর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারে নি।
ক্রুসেডাররা এই যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি অর্থাৎ গণহত্যা চালায়। লুপুই শহরের পাদ্রি রেমন্ড ডি-সেন্ট জিলস লিখেছেন: ‘আমাদের সেনারা যখন বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রাচীর এবং টাওয়ার দখল করে ফেললো, আরব জনগণের মাঝে একরকমের ভীতি সঞ্চারিত হলো। মানুষের মাথাগুলো শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলো। কারো পেট ফেঁড়ে ফেলা হচ্ছিলো আবার অনেকের ভাগ্যে জুটেছিল আগুন পুড়ে মরা। মুসলমানদের ওপর যেসব বিপদ মুসিবত এসেছিল এই বর্ণনা তার সংক্ষিপ্তসার মাত্র।’
ক্রুসেডের দ্বিতীয় যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। ফলাফলশূণ্য ভাবে চলছিল এই যুদ্ধ। এরকম পরিস্থিতিতে কুর্দি নেতা সালাউদ্দিন আইয়ুবি মিশরের শাসনভার হাতে নিয়ে মিশর, সিরিয়া এবং মেসোপোটেমিয়ার দায়িত্বভার হাতে তুলে নেন। এভাবেই আইয়ুবি বংশের গোড়াপত্তন ঘটে। আইয়ুবি শাসনকালে ১১৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বায়তুল মোকাদ্দাস খ্রিষ্টানদের দখলমুক্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা পরাজয় বরণ করে। ক্রুসেডারগণ এই যুদ্ধকে তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ নামে অভিহিত করে থাকে। ১১৯২ সালে ব্রিটিশ বাদশা প্রথম রিচার্ড সালাউদ্দিন আইয়ুবির সাথে সাময়িকভাবে যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য হয়। তবে সেখানে-তাদের বিশ্বাসমতে-মাসিহির কবর যিয়ারতের জন্যে ফিলিস্তিনের সামান্য উপকূল তাদের এখতিয়ারে ছিল। কুদস দখল করার পর সালাউদ্দিন ক্রুসেডারদেরকে লিখেছিলেন:
‘কুদসের মর্যাদাকে আমি সম্মান করি, তাই সেখানে রক্তপাত করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। সেজন্যে ঐ স্থান ত্যাগ করার জন্যে তোমাদের নসিহত করছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে তোমাদের মালামাল নিরাপদ থাকবে।’ কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্রুসেডাররা তাঁর এই উপদেশ গ্রহণ করলো না। তাই পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং সালাউদ্দিন আবারো ক্রুসেডারদের পরাজিত করে। সালাউদ্দিনের হাতে কুদস মুক্ত হবার ঘটনা ইউরোপীয়দের কাছে ছিল অসহনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। সেজন্যে তারা নতুন করে হামলার ঘটনা শুরু করে।
ক্রুসেড-যুদ্ধ বিক্ষিপ্তভাবে ১২৯১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যুদ্ধ সমাপ্তির পর যেই ফিলিস্তিন ছিল খ্রিষ্টানদের দখলে তা পুনরায় মুসলমানদের হাতে ফিরে আসে।
দুই শতাব্দিব্যাপী সংঘটিত ঐ ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাসে খ্রিষ্টান এবং মুসলিম বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছিল। আজকের বিশ্বের দিকে তাকালে মনে হবে যেন পুরোণো সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করা যাবে মুসলমানদের মাঝে সেই পুরোণো দিনের বিচ্ছিন্নতা এসে ভর করেছে। তারা বিভিন্ন ফেরকার কথা বলে নিজেদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপণ করে রেখেছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে খ্রিষ্টানরা এবং ইহুদিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেজন্যেই তারা এখন ‘ইহুদিদের পবিত্র স্থান’-এই অজুহাত তুলে ফিলিস্তিনেীদের বাড়িঘর পর্যন্ত দখল করে বসেছে। মুসলিম সরকার কিংবা বিশ্বসংস্থাগুলো আজ এই দখলদারদের ব্যাপারে চুপচাপ বসে আছে। তাদের এই নীরবতা দখলদারদেরকে আরো বেশি উৎসাহ যোগাচ্ছে। অথচ এই বায়তুল মোকাদ্দাসকে বলা যায় সকল ধর্মের জননী। মুসলমানদের বসে বসে ঝিমানোর সুযোগে আর খ্রিষ্টানদের বিচ্যুতির কারণে এখন এই শহরটি ইহুদি রং ধারণ করতে যাচ্ছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৫