এপ্রিল ২৯, ২০১৮ ২০:৪১ Asia/Dhaka

সে রাতে মা আমিনার অনুভূতি ছিল অন্যরকম। কয়েক মাস হলো তিনি বিধবা হয়েছেন এবং মৃত স্বামী আব্দুল্লাহর শোকেই কেটে যাচ্ছে তাঁর দিন-রাত। এদিকে গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে।

সে সময় তিনি ভাবছিলেন, যদি আজ স্বামী আব্দুল্লাহ বেঁচে থাকতেন এবং সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার মুহূর্তে তাঁর পাশে থাকতেন তাহলে কতই না ভালো হতো। এ সময় আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় মা আমিনার ঘর হঠাৎ আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল, আকাশের সব তারা যেন তার ঘরে নেমে এসেছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই তিনি নিজের শিয়রে নূরের আলোর মতো দু’জন নারীকে দেখতে পান। তাঁদের একজন বললেন- আমি ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া এবং দ্বিতীয়জন নিজেকে ইমরান কন্যা মারিয়াম বলে পরিচয় দিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মা আমিনার কোল জুড়ে এল এমন এক পুত্রসন্তান যার উপস্থিতি পৃথিবীর সকল অন্ধকার দূর করে দিয়েছিল। এ সময় আমিনা একটি গায়েবি কণ্ঠ শুনতে পান যেখানে বলা হচ্ছিল: “হে আমিনা, তোমার সন্তানের মধ্যে অতীতের নবী-রাসূলদের উন্নত গুণাবলীর সমাহার ঘটেছে। এসব গুণের মধ্যে রয়েছে নুহের সাহস, ইব্রাহিমের একনিষ্ঠ ঈমান, ইউসুফের সৌন্দর্য, সালেহ’র বাগ্মিতা, মূসার অদম্য মানসিক শক্তি এবং ঈসার ইবাদত ও ক্ষমা।”

 

মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আব্দুলমুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর সন্তান। তাঁর মা আমিনা ছিলেন ওয়াহাবের কন্যা। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে যে বছর আব্রাহা ক্বাবাঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে মক্কায় হামলা করে নিজেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সে বছরের ১৭ রবিউল আউয়াল/মতান্তরে ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মাদ (সা.)।  রাসূলে খোদার জন্মের পরপর আকাশে এমন কিছু তারা দেখা যায় যেগুলো তার আগে দেখা যায়নি। ইরানের সম্রাট কাসরার রাজপ্রাসাদ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং এটির ১৪টি স্তম্ভ ধসে পড়ে। পারস্যের অগ্নি-উপাসকদের অগ্নি-মন্দির নিভে যায়। অথচ এই মন্দিরের আগুন এর আগে কয়েক হাজার বছর ধরে একটানা জ্বলছিল। বিশ্বের বহু স্থানে মূর্তিপূজকদের মন্দির ধসে পড়ে এবং মূর্তিগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।

 

সেকালে সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারগুলোর রীতি ছিল সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার প্রতিপালনের দায়িত্ব একজন দাঈ মা’র হাতে তুলে দেয়া। মক্কার এই অঞ্চলে বানি সা’দ গোত্রের দাঈ মা’দের সুখ্যাতি ছিল। তারা বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মক্কায় আসতেন এবং প্রত্যেকে একজন করে নবজাতককে নিয়ে নিজের গোত্রে ফিরে যেতেন। কিন্তু মা আমিনার সন্তান কোনো দাঈ মা’র বুকের দুধই পান করছিলেন না। এক পর্যায়ে হালিমা সাদিয়া নামের একজন দাঈ এলেন। এবার নবজাতক তার কোলে যান এবং তার বুকের দুধ পান করেন। এর ফলে দাদা আব্দুলমুত্তালিব ও মা আমিনা খুশি হন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। মা হালিমা নবজাতককে নিয়ে নিজ এলাকায় চলে যান। মুহাম্মাদ (সা.)’র উপস্থিতি হালিমার সংসারের সব অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘুঁচিয়ে দেয় এবং তার পরিবারের ভাগ্য খুলে যায়। মা হালিমার উদ্ধৃতি দিয়ে ঐতিহাসিকরা লিখেছেন: “যেদিন মুহাম্মাদকে নিজের ঘরে এনেছি সেদিন থেকে আমার সংসার বরকতময় হয়ে ওঠে এবং আমার সম্পদ ও পশুর সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে।”

 

পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত আব্দুলমুত্তালিবের দৌহিত্র বনি সা’দ গোত্রে প্রতিপালিত হন। এরপর মরু জীবন ত্যাগ করে তাঁকে মক্কায় নিয়ে আসা হয় এবং মা আমিনা বুকের ধন ফিরে পান।  শিশু মুহাম্মাদ একদিন এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে মায়ের সঙ্গে মদীনা যান। সেখান থেকে ফিরে আসার পথে মা আমিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রাণত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর আব্দুলমুত্তালিব নিজ দৌহিত্রের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু দাদার স্নেহও তিনি বেশিদিন পাননি। বয়স আট বছর হতে না হতে দাদাও তাঁকে কাঁদিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করেন। এবার তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন চাচা আবুতালিব। এই চাচার গৃহেই মুহাম্মাদ (সা.) শিশু থেকে কিশোর এবং কিশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করেন।

 

বনি সা’দ গোত্রে মা হালিমার কাছে থাকার সময় মুহাম্মাদ (সা.) পশুপালনের কাজ শিখেছিলেন যে কাজ তিনি দাদা এবং চাচার কাছে থাকার সময়ও করতেন।  বাস্তবতা হচ্ছে, আল্লাহর বেশিরভাগ নবী ও রাসূল নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগে জীবনের কোনো না কোনো সময়ে পশুপালন করেছেন।  মাঠে মেষ চড়াতে গিয়ে তাঁদেরকে যে চরম ধৈর্য ধারণ করতে হয় পরবর্তীতে মানুষের মাঝে দাওয়াতের কাজ করার সময় সে ধৈর্য কাজে লাগে। মানুষকে দ্বীনের পথে আনার পথে নানা দুঃখ-কষ্টকে তখন আর কষ্টই মনে হয় না। পাশাপাশি মাঠে মেষ চড়াতে যাওয়ার ফলে মক্কার কলুষিত জীবন থেকে মুহাম্মাদ (সা.) মুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি আল্লাহর সৃষ্টিজগত, আকাশ, নক্ষত্ররাজি পর্যবেক্ষণ করে সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা করেন। পুতপবিত্র চরিত্রের কারণে কৈশোরেই তিনি সমবয়সী কিশোরদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানুষ হয়ে ওঠেন। মক্কার কলুষিত সমাজের আর দশটি কিশোর যখন মারামারি, কাটাকাটি ও ঋপুর চাহিদা পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.) এসব অন্যায় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখে পরম পবিত্র ও সম্মানিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।

সেই কিশোর বয়সে তিনি যেসব উত্তম কাজ করেছিলেন এবং পরবর্তীতেও মাঝেমধ্যে তিনি খুশিমনে সেই ঘটনা বর্ণনা করতেন তা ছিল হিলফুল ফুজুল অঙ্গীকার।  সমাজের নির্যাতিত ও অসহায় মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য কুরাইশের লোকেরা ওই অঙ্গীকার করেছিল। কুরাইশ বংশের লোকেরা সে যুগে মক্কার বাইরে থেকে আগত গোত্রের লোকদের ওপর জুলুম করত। একদিন ইয়েমেন থেকে এক ব্যবসায়ী মক্কায় আসেন পণ্য বিক্রি করতে। এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে পণ্য কিনে তার দাম না দেয়ায় দু’জনের মধ্যে বচসা শুরু হয়। এ অবস্থায় ওই ব্যবসায়ী কাবার পাশে বসে থাকা কুরাইশ বংশের কিছু মানুষের কাছে অভিযোগ করেন। বিষয়টি অনেকদূর পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ বংশের কয়েকটি গোত্রের লোক বিষয়টি সুরাহা করার জন্য আলোচনায় বসে।  তারা আল্লাহর নামে এই অঙ্গীকার করে, তারা সবাই জালিমের মুকাবিলায় ও মজলুমের সাহায্য-সমর্থনে ‘এক দেহ এক প্রাণ’ হয়ে কাজ করবে,যতক্ষণ না জালিম মজলুমের হক পরিশোধ করে। কুরাইশরা এই অঙ্গীকারের নাম দেন ‘হিলফুল-ফুজুল’ অর্থাৎ ফুজুলের অঙ্গীকার।  এরপর তারা সকলে মিলে ক্রেতা ব্যক্তির কাছ থেকে পণ্য দ্রব্যাদি জোরপূর্বক গ্রহণ করে এবং ইয়েমেনি ব্যবসায়ীকে ফিরিয়ে দেয়। মুহাম্মাদ (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্তির প্রায় ১৫ বছর আগে এই অঙ্গীকার সই হওয়ার ঘটনায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেটি ছিল তখন পর্যন্ত আরবদের মধ্যে স্বাক্ষরিত সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চুক্তি।

মহানবী (সা.)’র জীবনীর দিকে তাকলে দেখা যাবে, আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের বর্বর যুগে বসবাস করার পরও তিনি নিজেকে সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও অপরাধ জগত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি উন্নত মানবীয় গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে নিজেকে গুণান্বিত করেছিলেন। এ কারণে নবুওয়াত প্রাপ্তির বহু পূর্বে আরব উপত্যকার মানুষের কাছ থেকে তিনি ‘আমিন’ উপাধি লাভ করেছিলেন এবং সবার আস্থাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির আগের জীবনের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

একবার মক্কার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ক্বাবা শরিফের আয়তন বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা আল্লাহর ঘরকে ভেঙে নতুন করে তৈরি করেন এবং সবশেষে ধর্মীয় দিক দিয়ে অতি মূল্যবান পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’কে নির্ধারিত স্থানে প্রতিস্থাপন করার সময় ঘনিয়ে আসে। এ সময় পাথরটি স্থাপন নিয়ে মক্কার চারটি গোত্রের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। প্রত্যেক গোত্র কাজটি করতে চায় এবং কেউ অন্য গোত্রকে এ কাজ করতে দিতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।  বিষয়টি নিয়ে ঝগড়া-বিবাদের এক পর্যায়ে সবাই খাপ থেকে তরবারি বের করে ফেলে। প্রয়োজনে প্রাণ যাবে তবু অন্য গোত্রকে এ কাজ করতে দেবে না। এ অবস্থায় কুরাইশ অধিপতিরা আসন্ন রক্তপাত বন্ধের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ আবু উমাইয়া বিন মুগিরা বলেন: এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা এক কাজ করতে পারি। আমরা প্রথম যে ব্যক্তিকে ‘সাফা’ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখব তাকে এ সমস্যার সমাধান দিতে বলব এবং তিনি যে ফয়সালা দেবেন আমরা সবাই তা মেনে নেব। এ অবস্থায় দেখা গেল মুহাম্মাদ (সা.) ওই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করছেন। তখন সবাই সমস্বরে বলে উঠল: মুহাম্মাদ আমিন এসেছে, সে যে ফয়সালা দেয় আমরা তা মেনে নেব।

মুহাম্মাদ (সা.) বিবাদের কারণ শোনার পর নিজের পরনের আবা’টি মাটিতে বিছিয়ে দেন। এরপর তার ওপর পাথরটি রাখেন। চার গোত্রের একজন করে প্রতিনিধিকে বলেন আবা’টি ধরে কালো পাথরটি নির্ধারিত স্থানের কাছে নিয়ে যেতে। সবাই খুশিমনে তাই করে এবং এর মাধ্যমে এই পাথর স্থাপনের কাজে সবাই অংশগ্রহণ করে। এরপর মুহাম্মাদ (সা.) নিজের হাতে পাথরটি তুলে নির্ধারিত স্থানে বসিয়ে দেন। এর ফলে মক্কার কুরাইশরা একটি অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ থেকে রক্ষা পায়। বর্তমানে এই পাথর কাবাঘরের পূর্ব কোণে ভূমি থেকে দেড় মিটার উচ্চতায় বসানো রয়েছে। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ২৯

ট্যাগ