জুন ১৭, ২০১৮ ২০:২০ Asia/Dhaka

সুরা ওয়াকেয়ার আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গত পর্বের আলোচনায় আমরা বেহেশতিদের জন্য নির্ধারিত খোদায়ি নেয়ামত এবং সুখ ও আনন্দের নানা উপকরণের কথা উল্লেখ করেছি।

এইসব বেহেশতি নেয়ামতের কথা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলছেন,এসবই হল বেহেশতিদের কৃত নানা সৎ কাজের প্রতিদান।

এরপর সুরা ওয়াকিয়ার ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘তারা তথায় অবান্তর ও কোন খারাপ বা পাপ-পংকিলতাময় কথা শুনবে না,কিন্তু শুনবে সালাম আর সালাম।’

আসলে বেহেশতে যা আছে তার সবই হচ্ছে মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও করুণার নিদর্শন। সেখানে যা রয়েছে তার সবই হচ্ছে সৌন্দর্য,পবিত্রতা,গভীরতা ও অর্থময়তায় পরিপূর্ণ। অসার ও চপলমতি কথা বা গুরুত্বহীন বাক্যালাপের কোনো স্থান সেখানে নেই। বেহেশতের সভা-সমাবেশগুলো গভীর ভালবাসা ও আন্তরিকতায় ভরপুর। বেহেশতিরা শুনতে পাবেন কেবলই সালাম ও প্রশংসা। এমনকি মহান আল্লাহ ও ফেরেশতারা সালাম ও প্রশংসা করবেন বেহেশতবাসীদের উদ্দেশে। বেহেশতবাসীরাও একে-অপরকে করবেন সালাম ও প্রশংসাসূচক অভিবাদন।

সুরা ওয়াকিয়ার ২৭ নম্বর আয়াত ও তার পর থেকে ডান দিকের অধিবাসী বা গ্রুপকে খুব সুন্দর অভিধায় ডাকা হয়েছে। এই গ্রুপ খোদায়ী পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে তাদের ডান হাতে দেয়া হবে নিজ নিজ কর্ম-তৎপরতার রিপোর্ট তথা আমলনামা। প্রকৃত সৌভাগ্যবান হলেন এই শ্রেণীর মানুষ। তারাও বেহেশতের অপার সুখ আর সমৃদ্ধির কারণে আনন্দিত হবেন। অবশ্য এই শ্রেণীর চেয়েও উচ্চতর শ্রেণীর বেহেশতিরা হচ্ছেন অগ্রবর্তীদের দল তথা সাবিকুন।  

আর বিচার-দিবসের তৃতীয় শ্রেণী হল আসহাবে শিমাল তথা বাম দিকের অধিবাসী। এই গ্রুপের অধিবাসীরা আমলনামা পাবে বাম হাতে। তারা থাকবে কালো ও গাঢ় ধোঁয়ার ছায়ার নীচে যা মোটেই শীতল ও প্রশান্তিদায়ক নয়। তাদের ওপর বইবে এমন বাতাস যা জ্বালিয়ে দেয় সর্বাঙ্গ এবং তাদেরকে দেয়া হবে ফুটন্ত গরম পানি।

সুরা ওয়াকিয়ার ৪৫ থেকে ৪৮ নম্বর আয়াতে বাম দিকের গ্রুপের তথা কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের অশুভ পরিণতির তিনটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এই তিন কারণ হল: প্রথমত এরা পৃথিবীতে তথা ইহ-জীবনে ছিল খুবই অহংকারি ও স্বার্থপর। তারা মহান আল্লাহর নেয়ামতগুলো ভোগ করত এবং  অলস, অকর্মণ্য ও বিলাসি জীবন যাপন করত। দ্বিতীয়ত তারা বড় বড় পাপাচারে জড়িয়ে থাকার বিষয়ে অবিচল থাকত। আর তৃতীয়ত তারা কিয়ামত বা বিচার-দিবসকে অস্বীকার করত। তারা বলত: মরে যাওয়ার পর মাটিতে মিশে যাবে মানব শরীর। ছিন্নভিন্ন কংকাল থেকে কিভাবে আবারও মানুষের পুনরুত্থান ঘটবে?

কাফিরদের এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে সুরা ওয়াকিয়ার ৪৯ ও ৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ রাসুলকে (সা) সম্বোধন করে বলছেন: আপনি বলুন (হে রাসুল!) পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণ, সবাই একত্রিত হবে এক নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে।

সুরা ওয়াকিয়ার ৬৩ নম্বর আয়াত ও এরপর থেকে পরকালীন জীবনের প্রমাণ হিসেবে তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ তিনটি বিষয় হল: খাদ্যদ্রব্যের দানা, পানি ও আগুন। এ তিনটি বিষয় হল মানব-জীবনের জন্য অতি জরুরি তিন উপাদান। এ প্রসঙ্গে  সুরা ওয়াকিয়ার ৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'তোমরা যে বীজ বপন কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তাকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী ?'

-এটা স্পষ্ট যে মানুষ কেবল বীজ বপন করতে পারে। কিন্তু বীজ থেকে গাছের অংকুর-উদগম করানো মহান আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি উদ্ভিদের কাঠামোয় যেসব ব্যবস্থা রয়েছে সেসব এমন একটি শিল্প শহরের চেয়েও জটিল ও বিস্ময়কর যে শহরে রয়েছে বহু কল-কারখানা।

মহান আল্লাহ একটি বীজের ভেতরে খুবই ক্ষুদ্র একটি জীবন্ত কোষ সৃষ্টি করেছেন যে উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই তা থেকে চারা জন্ম নেয় ও তার শেকড়ও গজাতে থাকে। চারা গজানোর শুরুর দিকেও উদ্ভিদ বীজ থেকেই তার জন্য জরুরি নানা খাদ্য নিতে থাকে। আর এরপর চারা গাছ খুব বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে ভূমি থেকে খাদ্য ও পুষ্টি সংগ্রহ করতে থাকে এবং গাছটির ভেতরকার নানা যন্ত্র ও পরীক্ষাগার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবে ধীরে ধীরে গজিয়ে ওঠে মূল দেহ, কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা এবং ফল ও ফুলের গুচ্ছ। আর এ প্রক্রিয়ায়  একটি শস্যের বীজ থেকে গজানো গাছ বা শীষ জন্ম দেয় বহু ফল বা শষ্য যার সংখ্যা কখনও কখনও হাজারও ছাড়িয়ে যায়।

এরপর মহান আল্লাহ গাছের বীজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, আমি চাইলে শস্যকে শুস্ক ও খড়ের মত নির্জীব করে দিতে পারি। আর এ অবস্থায় তোমরা হতবাক হয়ে যাবে!  

-মহান আল্লাহ চাইলে শস্যের ক্ষেতগুলোকে ঝড়-তুফান দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারেন, কিংবা পঙ্গপাল বা পোকা-মাকড় পাঠিয়েও সেগুলোকে নির্মূল করে দিতে পারেন। তাই এটা বোঝা উচিত যে শস্য, ফল বা ফসলের সব বরকত আসে অন্য স্থান থেকে তথা মহান আল্লাহর ইচ্ছা থেকেই।

সুরা ওয়াকিয়ার ৬৮ থেকে ৭০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: তোমরা যে পানি পান কর,সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করলে তাকে তিক্ত ও লোনা করে দিতে পারি,তাহলে তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা জানাও না?

-আল্লাহ চাইলে অ্যাসিড মিশতো বৃষ্টির পানির সঙ্গে এবং তা শস্য ও ফলের স্বাদকে প্রভাবিত করত। সমুদ্রের নোনা পানিসহ ও নদ-নদীর যে পানি বাস্প হয়ে আকাশে ওঠে ও বৃষ্টি হয়ে আবার যখন তা জমিনে নামে তখন তাতে তিক্ততা ও অম্লতা থাকতে পারত এবং থাকতে পারত বহু ধরনের ক্ষতিকর জীবাণু। কিন্তু মহান আল্লাহর করুণাপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে বৃষ্টির পানি সবচেয়ে স্বচ্ছ, সুপেয় ও খাঁটি পানি হিসেবে মানুষের জন্য অফুরন্ত কল্যণ বয়ে আনে।

পারলৌকিক জীবনের আরেকটি নিদর্শন হল আগুনের অস্তিত্ব। আগুন মানব জীবনের জন্য অতি জরুরি উপাদান। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে সুরা ওয়াক্বিয়ায় বলছেন:

'তোমরা যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি?

তোমরা কি এর বৃক্ষ সৃষ্টি করেছ, না আমি সৃষ্টি করেছি ?

আমি সেই বৃক্ষকে করেছি শিক্ষার স্মরণিকা এবং মরুবাসী বা মুসাফিরদের জন্য  জ্বালানীর সামগ্রী। অতএব, আপনি আপনার মহান পালনকর্তার নামে পবিত্রতা বা তাসবিহ ঘোষণা করুন।'

সুরা ওয়াকিয়ার শেষের দিকে মহান আল্লাহ মৃত্যুর দিকে ইশারা করে বলছেন:

অতঃপর যখন কারও প্রাণ কন্ঠাগত হয়। এবং তোমরা তাকিয়ে থাক,

তখন আমি তোমাদের চেয়ে তার বেশি কাছে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না।

যদি পরকালে তোমাদের হিসাব-কিতাব না হওয়াই ঠিক হয়, তবে তোমরা এই আত্মাকে ফিরাও না কেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও ?

-মহান আল্লাহই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই জীবন দেন ও জীবন কেড়ে নেন এবং তিনি চাইলেই তাকে আবারও জীবিত করতে পারেন। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ১৭