সুরা হাশরের প্রাথমিক পরিচিতি ও ব্যাখ্যা
সুরা হাশর পবিত্র কুরআনের ৫৯ তম সুরা। ২৪ আয়াতের এ সুরা নাজিল হয়েছে পবিত্র মদিনায়।
এই সুরার সবচেয়ে বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে বনি নাজির নামক একটি ইহুদি গোত্রের সঙ্গে একদল সংগ্রামী মুসলমানের সংগ্রামের কাহিনী। সুরা হাশরের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে: সব অস্তিত্বের পক্ষ থেকেই মহান আল্লাহর গুণগান ও প্রশংসা, চুক্তি লঙ্ঘনকারী মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘর্ষের কাহিনী, মদিনার মুনাফিক সম্প্রদায় ও ইহুদিদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা, গোটা মুসলিম সমাজের প্রতি উপদেশ ও সতর্কবাণী। এ ছাড়াও এ সুরায় রয়েছে পবিত্র কুরআন সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা, মহান আল্লাহর নানা গুণ ও মহত্ত্ব এবং সুন্দর কিছু নামের বর্ণনা। সুরা হাশর শুরু ও শেষ হয়েছে মহান আল্লাহর প্রশংসার মধ্য দিয়ে।
সুরা হাশরের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে: আকাশ ও জমিনগুলোতে যা কিছু আছে,সবই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে। তিনি পরাক্রমশালী মহাজ্ঞানী।
- প্রতিটি বস্তু ও অস্তিত্বের এক ধরনের অনুভূতি রয়েছে। আর বিজ্ঞানীরাও আজকাল এ বিষয়টি স্বীকার করছেন। তাই আকাশ ও জমিনের তথা বিশ্ব-জগতের সব কিছুই যে আল্লাহর প্রশংসা করবে-এটাই স্বাভাবিক; যদিও সব বস্তু ও অস্তিত্বের অনুভূতি এবং তাদের পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর প্রশংসার ধরন মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।

মুসলমানরা যখন মহানবী (সা)'র নেতৃত্বে মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তখন সেখানে কয়েকটি ইহুদি গোত্রও মুসলিম সমাজের সঙ্গে শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। বনি নাজির, বনি ক্বুরাইজা ও বনি ক্বাইনুক্বা ছিল- এ ধরনের কয়েকটি ইহুদি গোত্র। কিন্তু এই তিনটি গোত্র মুসলমানদের সঙ্গে শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও যখনই সুযোগ পেত তখনই এই চুক্তি লঙ্ঘন করত। উহুদ যুদ্ধের পর হিজরি তৃতীয় সনে এইসব ইহুদি গোত্রের প্রধান নেতা কা'ব বিন আশরাফ ৪০ জন অশ্বারোহী সহযোগীসহ মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এই তিন গোত্রের ইহুদিরা মহানবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবে বলে কা'ব কুরাইশদের সঙ্গে এক ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
কিন্তু ওহির মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা)-কে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দেন।
ইতিহাসে এসেছে একদিন মহানবী (সা) তাঁর কয়েকজন মহান সঙ্গী বা সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে বনি-নাজির গোত্রের এলাকায় যান এবং কা'ব বিন আশরাফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি যখন ইহুদিদের দূর্গের বাইরে কা'ব-এর সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন ষড়যন্ত্রপ্রবণ ইহুদিরা মহানবীকে হত্যার একটি ষড়যন্ত্র করে। তারা যখন দূর্গের ওপর থেকে মহানবীর মস্তক-মুবারক লক্ষ্য করে একটি বড় পাথর নিক্ষেপের চক্রান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় তখনই মহান আল্লাহ ওহির মাধ্যমে এ বিষয়টি তাঁর সর্বশেষ রাসুলকে জানিয়ে দেন। ফলে বিশ্বনবী (সা) সেখান থেকে উঠে যান এবং মদিনায় ফিরে আসেন। এভাবে ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তি-চুক্তি লঙ্ঘন করায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় মুসলমানরা। ফলে ইহুদিরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে একটি শক্তিশালী দুর্গে আশ্রয় নেয় এবং দুর্গের দরজা খুব শক্তভাবে বন্ধ করে দেয়।
রাসুলে খোদা (সা) মহান আল্লাহর নির্দেশে ওই ইহুদিদেরকে ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন। কয়েক দিন ধরে তাদেরকে অবরুদ্ধ রাখার পর রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে মহানবী (সা) ওই ইহুদিদেরকে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তারা ওই প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ভয়ের কারণে বেশিরভাগ জিনিষপত্র না নিয়েই মদিনা ছেড়ে চলে যায়। ফলে ঘর-বাড়ি, ভূমি ও বাগান বা ক্ষেত-খামারসহ তাদের বাদ-বাকি সব সম্পদ মুসলমানদের মালিকানাধীন হয়ে পড়ে।
সুরা হাশরের এক থেকে ৫ নম্বর আয়াতে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও পতনের ওই কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন:
'তিনিই কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কাফের,তাদেরকে প্রথমবার একত্রিত করে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বহিষ্কার করেছেন। তোমরা ধারণাও করতে পারনি যে,তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে,তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা করবে। এরপর আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমন দিক থেকে আসল যে তার কল্পনাও তারা করেনি। আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন। তারা তাদের বাড়ী-ঘর নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। অতএব,হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।

- মদিনার ইহুদি গোত্র বনি-নাজির এত বেশি সম্পদ ও নানা শক্তি-সামর্থ্য এবং অস্ত্রের অধিকারী ছিল যে তারা এবং তাদের সহযোগী বা বিপক্ষের কেউ কখনও এটা চিন্তাও করতে পারেনি যে এই ইহুদি গোত্র এত সহজেই পরাজিত হবে। কিন্তু মহান আল্লাহ'র ইচ্ছার বিপরীতে বিপুল শক্তি ও সম্পদও যে কোনো গোত্রকে রক্ষা করতে পারে না – বিনা যুদ্ধে বনি নাজির গোত্রের পরাজয়ই তা সবার কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ইহুদিরা এতই ভয় পায় যে তারা কেবল পরাজয় মেনে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। একইসঙ্গে ইহুদিদের বাড়ি-ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে স্বেচ্ছায় সহযোগিতাও করে। মুসলমানরা ইহুদিদের দুর্গগুলো ধ্বংস করছিল তাতে প্রবেশ করার জন্য। অন্যদিকে ইহুদিরা ভেতর থেকে তা ধ্বংস করছিল যাতে মুসলমানরা ইহুদিদের বাড়ি-ঘরগুলোকে অক্ষত অবস্থায় দখল করতে না পারে!
ইহুদি গোত্রগুলোর এ ধরনের পরাজয়ে মুসলমানসহ সবার জন্যই রয়েছে বড় শিক্ষা। ষড়যন্ত্রপ্রবণ ইহুদিরা এ ধরনের ষড়যন্ত্রের শাস্তি হিসেবেই বিশ্বের নানা প্রান্তে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ২৩