সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮ ১৫:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: কেরমান প্রদেশের কিছু দর্শনীয় নিদর্শন

ঘুরে বেড়ানোর শুরুটা করা যাক ‘মেইমান্দ’ গ্রামের সৌন্দর্য দেখার মধ্য দিয়ে। মেইমান্দ একটি পাথুরে পাহাড়ে অবস্থিত গ্রাম। কয়েক হাজার বছর আগের এই পার্বত্য গ্রামটি বিশ্বের ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সপ্তম নিদর্শন হিসেবে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মার্কারি পুরস্কার’ পেয়েছে।

১৪ বছর আগে গ্রিক সরকার, ইউনেস্কো এবং আইকোমুসের যৌথ উদ্যোগে এই পুরস্কারটি চালু করা হয়। আইকোমুসের কাজ হলো ঐতিহাসিক অঞ্চল এবং স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করার উদ্দেশে গঠিত সংস্থা। যেসব নিদর্শন বা স্থাপনা  সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে অনন্য সাধারণ, প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের সেসব নিদর্শনকেই মার্কারি পুরস্কার দেওয়া হয়।

 কেরমান প্রদেশের ববাক শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে মেইমান্দ গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ২ শ ৪০ মিটার। মেইমান্দ গ্রামটি নিঃসন্দেহে বিশ্বে মানব বসতির একটি প্রাচীনতম নিদর্শন। বারো হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা এই গ্রামটি এখনো তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বরং বলা ভালো প্রাচীন ঐতিহ্যের সকল ঐশ্বর্য বজায় রেখে আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের ধারণা মেইমান্দ গ্রামটি গড়ে উঠেছিল যখন ইরানীরা ছিল সূর্যপূজারী। তারা গুহার অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশকে বেছে নিয়েছিল নিজেদের ইবাদত করার সুবিধার্থে। আবার যারা এখানে মারা যেত তাদেরকে পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে দাফন করা হত।

এভাবে মেইমান্দ গ্রামে বেশ কিছু প্রার্থনালয় বা ইবাদাতখানা এবং কবরস্থান গড়ে ওঠে। এ অঞ্চলের মানুষেরা পাহাড় কেটে কেটে তাদের বসবাস করার জন্যে বাড়িঘর তৈরি করে। অনেকের অভিমত হলো তারা আবহাওয়াগত কারণে এবং বিচিত্র প্রাকৃতিক কারণে ‘দাস্ত্‌কান্দ্‌’ নামক গুহাগুলোতে বসবাস করত। দাস্ত্কান্দ একটি ফার্সি শব্দ। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়াবে হাতে খনন করা। দাস্ত মানে হাত আর কান্দ এর মূল শব্দ কান্দান মানে হলো খোঁড়া বা খনন করা। ফলে দাস্তকান্দ গুহা বলতে বোঝাবে যেসব গুহা এলাকার লোকজন হাতে খুঁড়ে বানিয়েছে। যাই হোক, মেইমান্দ গ্রামে যেসব নকশা বা চিত্র পাওয়া গেছে সেগুলোর বয়স বিশেষজ্ঞদের মতে ১০ হাজার বছরেরও বেশি। আর এখানকার বিভিন্ন এলাকায় যেসব মাটির তৈজস পাওয়া গেছে সেগুলোর বয়স ৬ হাজার বছরের মতো।

 অ্যাতো পুরনো এবং সমৃদ্ধ নিদর্শনই প্রমাণ করে মেইমান্দ গ্রামটি কতো হাজার বছরের প্রাচীন একটি গ্রাম। অবশ্য পাথুরে স্থাপত্য নিদর্শনের বহু উদাহরণ বিভিন্ন দেশেও যে মেলে না তা নয়, তবে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং পর্যটনের দিক থেকে অ্যাতো সমৃদ্ধ ও সুন্দর গ্রামের নিদর্শন আর কোথাও নেই। তবে তুরস্কে এ রকম একটি গ্রাম আছে ‘কাপাদৌকিয়া’ নামে। সেই গ্রামটিও পাথুরে এবং আবাসিক। কাপাদৌকিয়া’র কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেইমান্দ গ্রামের মিল দেখতে পাওয়া যায়।

 মেইমান্দের আবহাওয়া পার্বত্য এবং নাতিশীতোষ্ণ। এই গ্রামটির অবস্থান এমন যে সমতলভূমি এবং পার্বত্য অঞ্চল উভয় এলাকার সাথেই সীমান্ত রয়েছে। ববাক শহর এবং মেইমান্দের মাঝে অবস্থিত এই সমতলভূমি অতীতকালে বুনো বাদাম আর পেস্তা গাছে ভরপুর ছিল। মেইমান্দ গ্রামের কাছেই তুত গাছ এবং শাহ তুত গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। মেইমান্দ প্রান্তরে গুইসাপ ধরনের প্রাণী, সাপ, সজারু, কচ্ছপের মতো বিচিত্র প্রাণীর নিশ্চিন্ত বসবাস রয়েছে। এ ছাড়াও মেইমান্দের পার্বত্য এলাকাতেও দেখা যায় হরিণ, চিতাবাঘ, নেকড়ে, শিয়াল, বুনো ছাগল এবং বিচিত্র শিকারী পাখি।

 কয়েকটি মৌসুমি নদী আর বেশ কটি খালও মেইমান্দ গ্রাম এবং তার আশপাশে দেখতে পাওয়া যায়। খনিজ পানির বেশ কিছু প্রবাহও লক্ষ্য করা যায় এখানে। মেইমান্দ গ্রামের লোকজনের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানো হয় তিনটি ক্ষেত্র থেকে। পেশাগত এই ক্ষেত্র তিনটি হলো কৃষিকাজ, পশুপালন এবং গালিচা তৈরি। নদী থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই কৃষিকাজের ক্ষেত্রে এ এলাকা বেশ অগ্রসর। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি অর্থকরী পেশা হলো গালিচা তৈরি। এর কারণ হলো মেইমান্দের গালিচার বেশ সুনাম সমগ্র ইরান জুড়ে তো রয়েছেই এমনকি বিশ্বব্যাপীও এর খ্যাতি রয়েছে ব্যাপক। মেইমান্দের গালিচার এই সুনামকে কেন্দ্র করে সহযোগী আরো কিছু পেশাও গড়ে উঠেছে। এগুলো হলো ডায়িং বা রং করার কাজ, পশমি বস্ত্র বা কম্বলে পশমের আস্তরণ দেওয়ার কাজ, গেলিম বানানোর কাজ, কুরুচ কাঁটা দিয়ে তৈরি শিল্পসহ আরো বহু ধরনের কৃষি সরঞ্জাম।         

আবহাওয়াগত কারণে মেইমান্দ এলাকার লোকজনের পেশা যেমন তিন ধরনের তেমনি তাদের আবাসনের ব্যবস্থাও তিন রকমের। তারা শীতকালে পাথরের তৈরি নিজেদের ঘরে বাস করে। এর কারণ হলো পাথরের ঘরে বরফ জমা কিংবা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। এই মৌসুমে নারীরা গালিচা বানানোর কাজে জড়িয়ে পড়ে আর পুরুষেরা পশুপালনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে বসন্তের আগমনে মেইমান্দের অধিবাসীরা আস্তে আস্তে সহনীয় এবং উপভোগ্য আবহাওয়াময় সবুজের সমারোহপূর্ণ এলাকার দিকে চলে যায়। এ সময় নারী পুরুষ সকলেই পশুপালন করা এবং দুধ দিয়ে বানানো পণ্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে গ্রীষ্মকাল ঘনিয়ে এলে মেইমান্দের লোকজন বাগবাগিচার কাজে নিয়োজিত হয়। বুনো পেস্তা, বুনো বাদাম, বাদাম, আখরোট, জিরা ইত্যাদি কৃষিপণ্য উৎপাদনের কাজে লেগে পড়ে। মেইমান্দের পেস্তা বাদাম এবং আখরোট খুবই নামকরা।

মেইমান্দে বসন্ত ঋতুতে ওষুধি গাছ আর লতাগুল্মে ভরে যায়। এগুলোর ভেষজ ঘ্রাণে এ সময় চারদিক মৌ মৌ করে। এখানকার সমতলভূমিতে ওষুধি গাছের অস্তিত্বও মেইমান্দবাসীদের অর্থনীতিক জোগানের আরেকটি উৎস হিসেবে পরিগণিত। এখানে লক্ষ্য করা যাবে বহু বৃদ্ধ মানুষ বার্ধক্যের ভারে নুইয়ে না পড়ে বরং দিব্যি সুস্থ শরীরে ভালোভাবেই বেঁচে আছে। তাদের সুস্বাস্থ্য আর নিরোগ জীবনের রহস্যের পেছনে স্থানীয় প্রাকৃতিক সুষমা আর তরতাজা খাবার দাবারের প্রভাব রয়েছে কিনা কেজানে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৮

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ