ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখে গাজা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব কেন?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i150700
পার্স টুডে- গাজায় ক্ষুধার কারণে যখন মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন নতুন রেকর্ড গড়ছে, তখন বিশ্ব সম্প্রদায় এই অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে 'দুর্ভিক্ষ' ঘোষণার বদলে রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশের মারপ্যাঁচে আটকে আছে।
(last modified 2025-07-26T14:21:01+00:00 )
জুলাই ২৬, ২০২৫ ২০:১৩ Asia/Dhaka
  • হোয়াইট হাউস
    হোয়াইট হাউস

পার্স টুডে- গাজায় ক্ষুধার কারণে যখন মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন নতুন রেকর্ড গড়ছে, তখন বিশ্ব সম্প্রদায় এই অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে 'দুর্ভিক্ষ' ঘোষণার বদলে রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশের মারপ্যাঁচে আটকে আছে।

সম্প্রতি আল জাজিরা ইংরেজিতে একটি নিবন্ধে  প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা মনসেফ খানে লিখেছেন, "খাদ্য নিরাপত্তায় বৈশ্বিক অগ্রগতির এই যুগে, তিন মাস বয়সী 'ইয়াহিয়া'র নিথর দেহের উপর কাঁদতে থাকা ফিলিস্তিনি মা 'আলা আল-নাজ্জার'-এর ছবি মানবতার বিবেককে নাড়া দিয়েছে।"

পার্স টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, 'আলা আল-নাজ্জা'র মতো শত শত ফিলিস্তিনি নারী আজ গাজায় সন্তান হারানোর বেদনায় নীরবে কাঁদছেন—যাদের শিশুরা পরিকল্পিত খাদ্যনির্ভর নিষ্ঠুরতার শিকার।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের জরুরি সতর্কতা

২০২৪ সালের ৯ জুলাই ২০২৪ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের অন্তত ১১ জন বিশেষজ্ঞ গাজায় দুর্ভিক্ষের বিষয়ে জরুরি সতর্কতা জারি করেছেন। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে: "ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ক্ষুধার্ত রাখার জন্য যে ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত অভিযান চালাচ্ছে, তা গণহত্যার এক রূপ এবং সমগ্র গাজায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্থলপথে মানবিক সাহায্য পৌঁছানো, গাজার অবরোধ তুলে নেওয়া এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকরের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে বলছি।"

এ বিবৃতিতে সাক্ষরকারী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন: মাইকেল ফাখরি (খাদ্যের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনকারী)পেদ্রো আরুহো-আগুদো (পরিষ্কার পানি ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক প্রতিবেদক), এবং ফ্রানচেস্কা আলবানিজে (অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদক)।

দুর্ভিক্ষ ঘোষণার মানদণ্ড

২০০৪ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক একীভূত শ্রেণিবিন্যাস (আইপিসি) পদ্ধতি চালু করে, যা দুর্ভিক্ষ মূল্যায়নের জন্য পাঁচ স্তরের পরিমাণগত স্কেল নির্ধারণ করে। আইপিসির মতে, দুর্ভিক্ষ ঘোষণার জন্য নিম্নলিখিত তিনটি শর্ত পূরণ হওয়া প্রয়োজন:

  • একটি এলাকার ২০% বা তার বেশি পরিবারের খাদ্যের মারাত্মক সংকট ও মোকাবিলার সীমিত ক্ষমতা থাকা।
  • শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ৩০% ছাড়িয়ে যাওয়া।
  • দৈনিক মৃত্যুর হার প্রতি ১০,০০০ জনে ২ জনের বেশি হওয়া।

এই তিনটি শর্ত পূরণ হলে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা উচিত। যদিও এই ঘোষণার আইনগত দায় নেই, কিন্তু এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা যা আন্তর্জাতিক সহায়তাকে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যেখানে বহু বিশেষজ্ঞ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বলছেন যে, গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে, সেখানে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কেন ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এই সত্যিটা স্বীকার করল না?

তথ্যের যুগে নীরবতা কেন?

আজকের বিশ্বে তথ্য আর গোপন থাকে না। গাজার বাস্তবতা পরিষ্কার—কঙ্কালসার দেহ, অনাহারে মৃত শিশুদের ছবি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। তবুও, ২০ জুলাই UNRWA যখন এক মিলিয়ন শিশুর খাদ্য সংকট নিয়ে সতর্ক করল, তাতেও 'দুর্ভিক্ষ' ঘোষণা এল না।

রাজনৈতিক স্বার্থ বনাম মানবিক দায়িত্ব

জাতিসংঘের বর্তমান সংস্কৃতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবাধীন কাঠামো, সেখানে পেশাদার দায়িত্ব নয় বরং রাজনৈতিক স্বার্থই প্রাধান্য পায়। জাতিসংঘের বহু কর্মকর্তা জানেন কী করা উচিত, কিন্তু পদ হারানোর ভয়ে নীরব থাকেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম আহমেদ খান এবং জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার ফ্রানচেস্কা আলবানিজে বারবার মার্কিন সরকারের ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, আলবানিজে কোনো পারিশ্রমিকও পান না—তাঁর কাজ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবামূলক, যা তাঁকে আরও সম্মানজনক করে তোলে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আরও কঠিন চাপে রয়েছেন—বিশেষ করে যখন মার্কিন কংগ্রেস জাতিসংঘের বাজেট কেটে দেওয়ার জন্য নজিরবিহীন বিল পাস করেছে। এই অবস্থায় 'ওয়াশিংটনের রোষানলে পড়ার ভয়ে চুপ থাকা' আর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয়।

গাজা অবরোধ: একটি যুদ্ধাপরাধ

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধানের ৮নং ধারা অনুযায়ী, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেসামরিকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষুধার্ত রেখে মারা যাওয়াকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২ মার্চ থেকে গাজার সম্পূর্ণ অবরোধ, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার প্রবেশ রোধ এবং এর ফলে শিশুদের অপুষ্টিতে মৃত্যু—সবই এই সংজ্ঞার আওতায় পড়ে। এ যেন পরিকল্পিত গণহত্যার আরেক রূপ।

বর্তমানে, মিশরের সীমান্তে কয়েক টন খাদ্য দ্রব্য পচে যাচ্ছে—আর গাজার শিশুরা একে একে মারা যাচ্ছে। ইসরায়েলি সেনা ও কিছু বিদেশি ভাড়াটে, যাদের নিয়োগ দিয়েছে তথাকথিত “গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন”, তারা সাহায্য বিতরণের স্থানগুলোতে ৯০০-এর বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুযায়ী, গাজায় প্রায় ৯০,০০০ নারী ও শিশু জরুরি অপুষ্টি চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছে। শুধু ২০ জুলাইতেই গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৯ জন মানুষ অনাহারে মারা গেছে এবং এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।

সংখ্যা নয়, মানুষের গল্প

প্রতিটি পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে একেকটি জীবনের গল্প। তিন মাস বয়সী ইয়াহিয়া, যে কখনোই একটি স্বাভাবিক জীবন দেখেনি, সেই প্রতীক—এই বর্বরতার প্রতিচ্ছবি।

আজকের বিশ্ব একটি কঠিন নৈতিক প্রশ্নের সামনে:
চুপ করে থেকে এই মানবিক ট্র্যাজেডিকে উপেক্ষা করবে, না কি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে অবরোধ ভেঙে দেবে? #

পার্সটুডে/এমএআর/২৬