ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪ ১৩:৪৮ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: কেরমান প্রদেশের সিরজান শহর

কেরমান প্রদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিরজান শহরটি।

এই শহরের আয়তন ১৭ হাজার ৪ শ ৮১ বর্গ কিলোমিটার। চারটি প্রদেশের ক্রসিং রোডের কাছে এবং তেহরান-বন্দরআব্বাসের মূল সড়কের কাছে পড়েছে সিরজান শহরটি। প্রদেশ চারটি হলো ফার্স, কেরমান, হরমুযগান এবং ইয়াযদ। যোগাযোগ ব্যবস্থার এরকম সুন্দর এবং উপযোগী সুযোগ সুবিধার কারণে সিরজান একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরের উচ্চতা ১৭ শ ৩০ মিটার। সিরজান জাগরোস পর্বতমালার কেন্দ্রীয় এবং পূর্বাঞ্চলীয় পর্বতগুলোর মাঝে অবস্থিত। এখানকার সবোর্চ্চ পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে চার গম্বুজ, পাঁচ গম্বুজ পাহাড় এবং এইনুল বাক্‌র পাহাড়। এই কটি পাহাড় এখানকার গুরুত্বপূর্ণ এবং উঁচু পাহাড়।

সিরজানের আশেপাশে রয়েছে ‘কাফে নামাক’ শহর এবং সামান্য দূরত্বে রয়েছে সমতল এলাকা ‘ইব্রাহিম আবাদ’। সিরজান শহর থেকে পূর্বদিকে পড়েছে এই সমতল এলাকাটি। এই শহরের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং শুষ্ক। গ্রীষ্ম তথা গরমের ঋতুতে এই শহরের আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ এবং শীতের সময় একেবারেই ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে। বরফ এবং বৃষ্টি এখন নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এই ঋতুতে। তবে বসন্তকালেও এখানে বৃষ্টিপাত হয় প্রায়ই। ভারত সাগর থেকে বয়ে আসা আর্দ্র আবহাওয়াই এখানে এই বৃষ্টিপাতের কারণ। সিরজানে বেশ কিছু মৌসুমি নদীও রয়েছে। এসব নদীর মধ্যে থাঙ্গুয়িয়ে বা পালাঙ্গি নদী এবং হোসাইন আবাদ নদী খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নামকরা দুটি নদী।

 

মরু প্রান্তীয় বা অর্ধ মরুপ্রান্তীয় আবহাওয়ার কারণে সেইসাথে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হবার কারণে কিংবা মৌসুমি বায়ুর প্রকোপ থাকার ফলে এবং তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্যের কারণে সিরজান এলাকাটি সবুজের সমারোহে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নি। তবে সিরজান পার্বত্য এলাকায় কিছু কিছু গাছ লক্ষ্য করা যায়। সিরজানের পশ্চিমাঞ্চলীয় এই গাছগুলোতে আর্দ্রতা এবং বৃষ্টির স্বল্পতার কারণে খুব বেশি একটা পাতা দেখতে পাওয়া যায় না। কদাচিৎ যদিও নজরে পড়ে সেগুলো পোকায় খাওয়া পাতার মতো শতছিদ্রময় কাটা কাটা। তাই মোটামুটি বলা যায় এখানকার গাছগুলো পাতাহীন। অন্তত এক হাজার প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যাবে এই এলাকায়। 

ইরানে যে পরিমাণ পেস্তা বাদাম উৎপাদিত হয় সিরজান এবং রাফসানজানে তার বেশিরভাগ উৎপন্ন হয়। সিরজানে উৎপন্ন পেস্তা পৃথিবী বিখ্যাত। এটা গুণগত মানের দিক থেকে যেমন তেমনি স্বাদের দিক থেকেও। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখানকার পেস্তা রপ্তানি করা হয়। সিরজানে অবশ্য পেস্তা ছাড়াও আখরোট, আপেল, চেরি ইত্যাদি ফলও প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়।

 

কেরমান প্রদেশের মধ্যে যতগুলো শহর আছে সেগুলোর মাঝে জনসংখ্যা এবং আয়তন উভয় দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হলো সিরজান। ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্যপঞ্জিতে পাওয়া যায় সিরজান শহরটি ইসলামপূর্ব কালে গড়ে উঠেছে। অনেকেই আশকানী বাদশা ‘বেলাশ’র সময়ে এই শহরটি নির্মিত হয়েছে বলে মত দিয়েছেন। আগেকার দিনে সিরজান শহরটি বেশ বড়ো এবং আবাদি ছিল। আশকানিয়ানদের আমলে বর্তমান কেরমানের গভর্নরের কার্যালয় ছিল এই সিরজানে। ৩১ হিজরিতে তৃতীয় খলিফা ওসমান বিন আফফান এই কেরমান জয় করার লক্ষ্যে আব্দুল্লাহ বিন আমেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। বিন আমের তখন তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে এই সিরজানেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন এবং শহরটি দখল করেছিলেন। 

ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার কারণে প্রাচীনকাল থেকেই সিরজানের গুরুত্ব ছিল যেমন এখনও রয়েছে। ইরানের রাজধানী শহর তেহরান থেকে ৯৬০ কিলোমিটার এবং কেরমান থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ শহর। পুরনো শহর হবার কারণে এখানে ইরানের ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বের অনেক কমপ্লেক্স এবং যাদুঘর গড়ে উঠেছে। এসব যাদুঘরে রক্ষিত নিদর্শনগুলোতে ফুটে উঠেছে প্রাচীন ইতিহাসের বহু প্রামাণ্য দিক। বিশেষ করে সিরজানে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনায় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের প্রাচীন যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো এক কথায় নজিরবিহীন।

 

নজিরবিহীন এ অর্থে সূর্যের আলো থেকে এনার্জি বা শক্তি সংগ্রহ করে স্থাপনার ভেতরে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সে সময়। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্যরকম মনে হতে পারে, সেজন্যেই নজিরবিহীন বলেছি। বিশ্বব্যাপী আধুনিক স্থাপত্যকলায় এখন বাসার ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে ঠাণ্ডা গরম নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়া যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তার সাথে প্রাচীন ওই ব্যবস্থার পদ্ধতিগত অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

 সিরজান শহরটা এখন বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক এবং শিল্পাঞ্চল হিসেবে ব্যাপক খ্যাতিময়। এখানে রয়েছে খনিজ অনেক সম্পদও। গোল গাহর আকরিক লোহার খনি, তামার খনি, মর্মর পাথরের সমৃদ্ধ খনি, লবণ, চুনা পাথর, বালি, চক ইত্যাদি খনির জন্য সিরজান বিখ্যাত। পাথর উত্তোলনের কাজ এখানে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। সিরজান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি সমগ্র ইরানের মধ্যে একটি উন্নত এলাকা হিসেবে আদর্শ স্থানীয়। বলাবাহুল্য যে সিরজান ইরানের মধ্যে মাল্টি পারপাস এরিয়া হিসেবে সবার আগে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করার সু ব্যবস্থাসহ শিল্প কলকারখানা এবং বাণিজ্যিক সকল কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সড়ক-রেল-আকাশসহ সকল রুটেই এই ব্যবস্থা রয়েছে। এ কারণেই দেশের সীমা ছেড়ে সিরজানের বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।

সিরজানে রয়েছে লবণ মরুভূমি। সিরজান শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লবণ মরু। প্রায় ৫০ কিলোমিটার লম্বা এবং ২০ কিলোমিটার চওড়া এই মরুভূমিটি। প্রাকৃতিক এইসব আয়োজন ছাড়াও সিরজানে রয়েছে পুরাতাত্ত্বিক বহু নিদর্শন। ‘কেল্লা সাঙ’ বা পাথর কেল্লার নামটি এ প্রসঙ্গে সবার আগে উঠে আসবে। পাথরের তৈরি এই কেল্লাটি যে বেশ মজবুত এবং দর্শনীয় তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। আলে মোজাফফারের সময়কার এ কেল্লাটি। সুলতান আহমদ মোজাফফারি কেল্লার ভেতর পাথর কেটে যে মিম্বারটি বানিয়েছেন সেটা তাঁর উন্নত রুচি এবং শৈল্পিক দৃষ্টির পরিচয় বহন করে। সিরজানে রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের কিছু খাদ্য সামগ্রী।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ২২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ