সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৮ ১৯:২৫ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৮২ : তুরস্কে ইসলামী জাগরণ

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বিগত দুটি আসরে আমরা ইরানে ইসলামী জাগরণ প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছিলাম। ইমাম খোমেনী (রহ) এর নেতৃত্বে ইরানের সেই ইসলামী জাগরণমূলক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করেছিল। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ইরানের সেই ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ঘটনা ছিল সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে এক অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

তুরস্কে ইসলামী জাগরণ প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করার জন্যে শুরুতে ওসমানী সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক কিছু ঘটনাপঞ্জির দিকে নজর বুলিয়ে নেওয়া যাক। তুর্কিরা আনাতোলি দখলের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ইসলামের প্রাথমিক বছরগুলোতে মুসলিম ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিল। বিশেষ করে হিজরি চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এ ক্ষেত্রে ভবঘুরে সূফি এবং দরবেশরা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সূফি দরবেশদের কারণেই আজ পর্যন্তও তুরস্কের জনগণের মাঝে সূফি তরিকার অসম্ভব গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের প্রভাব বিরাজ করছে। এই প্রভাব তুরস্কে ইসলামী জাগরণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

তবে শাসনকার্যে দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের ফেকহি এবং আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল সূফিয়ানী ইসলামের পাশাপাশি। ওসমানী সরকার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তাঁদের এই ভূমিকা ছিল। তখনকার সুলতান বা শাসকগণও তাঁদের বৈধতার ব্যাপারে এই তরিকাতপন্থী এবং শরিয়াতপন্থী- উভয় দিকের আলেমদেরই অনুমোদন নিতেন। আঠারো এবং উনিশ শতক ছিল মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশবাদের আধিপত্যের স্বর্ণযুগ। এ সময়টাতে ওসমানী সাম্রাজ্যবাদীদের দুই চিন্তাধারার লোক উপনিবেশবাদীদের সাথে দুই ধরনের আচরণ করতেন। একটি গ্রুপ যারা পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী তারা ওসমানী শাসন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন এবং সুলতান সোলায়মানের রীতিনীতির সাথে একাত্মতা পোষণ করে বিরাজমান পরিস্থিতি সুরক্ষার চেষ্টা করতেন। সুলতান সোলায়মান ছিলেন খ্রিষ্টীয় ষোলো শতকের শুরু এবং পণর  শতকের শেষ দিককার সুলতান বা তুর্কি শাসক। এই দলটি বিরাজমান পরিস্থিতিতে কোনোরকম পরিবর্তন আসুক-তা চাইতেন না বরং পরিবর্তন চিন্তার বিরোধিতা করতেন।

অপরদিকে আরেকটি দল ছিল যারা পরিবর্তন প্রত্যাশা করতো। তারা চাইতো পরিস্থিতি পাল্টে যাক, নতুনত্ব আসুক। তাদের এই পরিবর্তন চিন্তার সাফল্যের জন্যে তারা সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করতেন। তারা আসলে নিজেদের সাম্রাজ্য অটুট রাখার চেষ্টা করতেন। এজন্যে চাইতেন পশ্চিমাদের মতোই তাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেন জ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষাগত সকল পরিবর্তন বা উন্নয়ন আসে। একইভাবে সামরিক বাহিনীকে যেন ঢেলে সাজানো হয় এবং প্রশাসনিক বিভাগকেও যেন নতুন করে বেগবান করা হয়। তাদের দৃষ্টিতে এই সংস্কার করা হলে তবেই ইউরোপীয়দের আধিপত্য মোকাবেলা করা সম্ভব। সুলতান তৃতীয় সেলিম সংস্কারপন্থীদের চিন্তার অনুকূলে সর্বপ্রথম কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ঐ কর্মসূচিতে ইউরোপীয় আদলের নতুন ব্যবস্থার একটা সামগ্রিক রূপ দেওয়া হয় যার মাধ্যমে সংস্কারমূলক কার্যক্রম চলতে পারে। সুলতান তৃতীয় সেলিমের শাসনকাল ছিলো ১৭৮৯ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত। ধর্মীয় বহু নেতৃবৃন্দও তাঁর এই কর্মসূচি সমর্থন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তাতার জিক আব্দুল্লাহও রয়েছেন। তবে আলেমদের আরেকটি গ্রুপ তৃতীয় সেলিমের কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁরা ফতোয়া জারি করেছিলেন যে নতুন এই ব্যবস্থার ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে, দ্বীনের ভেতর বেদআত প্রবেশ করতে পারে এমনকি এই কর্মসূচির কোনো কোনো দিক কুফরি চিন্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই নতুন এই কর্মসূচি সোজা কথায় হারাম। এই ফতোয়ার পক্ষের আলেমগণ তাদের ফতোয়াটিতে স্বাক্ষর করার জন্যে সুলতান তৃতীয় সেলিমের কাছে পাঠান। এই শ্রেণীর আলেমদের নেতা ছিলেন শায়খুল ইসলাম আতাউল্লা আফান্দি। তিনি নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাতিল করার আহ্বান জানান এবং সেলিমকে উৎখাত করার ফতোয়া জারি করেন। এই ফতোয়ার কারণেই সুলতান সেলিম নিহত হয়েছিলেন বলে ইতিহাসে এসেছে।

তৃতীয় সেলিমের মৃত্যুর পর সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয় শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনিও সংস্কার কর্মসূচিগুলোর পুনর্জাগরণের চেষ্টা চালান। তিনি এই সংস্কার কর্মসূচিতে নতুনত্ব আনেন। এই নতুনত্ব হলো কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা এবং রক্ষণশীল শক্তিকে দমন করার পদক্ষেপ। তার শাসনামলে বিচার বিভাগ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিভাগ এমনকি ফতোয়া বিভাগ থেকে পর্যন্ত আলেমদের হাতকে সংকুচিত করে ফেলা হয়। যার ফলে আলেমদের শক্তি খর্ব হয় এবং তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েন। তবে ওসমানী হুকুমাতের সংস্কারের বিরুদ্ধে একটি সংগঠন তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এই সংগঠনটির নাম ছিলো ‘জমিয়তে ফেদায়িয়ন’। শায়খ আহমাদ সোলাইমানের আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়েছিল এই সংগঠনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলনটিতে অংশ নিয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন শায়খ, দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং ছাত্র। অনেকে তাই এই জমিয়তকে বিপ্লবী জমিয়ত নামেও অভিহিত করেছিলেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ‘কুলেলি’ ঘটনা এই আন্দোলনেরই প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল।

এই সংগঠনটি সাংবিধানিক আন্দোলন এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির দাবিতে সংগ্রাম শুরু করেছিল। কুলেলি ঘটনাটা এই আন্দোলনের ফলেই ঘটেছিল। ঘটনাটা ছিল উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামী জাগরণমূলক আন্দোলন। ওসমানী সাম্রাজ্যে পশ্চিমা রাজনৈতিক এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল জমিয়তে ফেদায়িয়ন। আরো একটি আন্দোলন বা সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছিল এ সময়। সংগঠনটির নাম ছিল ‘ওসমানী নয়া জমিয়ত’। পশ্চিমাপন্থীদের সংস্কার কর্মসূচির বিরুদ্ধে এই সংগঠনের কয়েকজন নেতা বা বুদ্ধিজীবী অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ইব্রাহিম শেনাসি, নমাক কামাল এবং জিয়া পাশা এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের অন্যতম কজন। এসব নেতৃবৃন্দ এবং তাঁদের অনুসারীগণ ছিলেন অনেকটা লিবারেল এবং দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আলেম ও ছাত্র। মোটামুটি প্রাগ্রসর চিন্তা করতেন তারা।

‘তাসভিরে আফকর’ বা চেতনার চিত্র নামের একটি দৈনিকে তাঁরা লেখালেখি করার মধ্য দিয়ে জনমত গঠন করেছিলেন। নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন। ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ এবং পশ্চিমা তোষণ নীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের নেতারা ছিলেন সোচ্চার। তবে ওসমানী সমাজের ঐতিহ্যের সাথে যেসব সংস্কারের মিল ছিল সেগুলোর বিরোধিতা তাঁরা করেন নি। তাঁরা মনে করতেন ইসলামী সমাজের বিচিত্র সমস্যা ও চাহিদার জবাব একমাত্র ইসলামই অর্থাৎ শরিয়তই দিতে পারে। আসলে প্রকৃত ইসলামী শাসনে ফিরে যাওয়াই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। পাশ্চাত্যপন্থী সংস্কারের বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ছাত্রদের বিদ্রোহও ছিল আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাদের এই আন্দোলনকে ‘সুফতেহ’ আন্দোলনও বলা হয়। মূলত এই আন্দোলনই মাহমুদ নাদিম পাশাকে গদিচ্যুত করেছিল। ওসমানী সাম্রাজ্যে ইসলামী জাগরণের ঘটনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইস্তাম্বুলে সাইয়্যেদ জামালুদ্দিন আসাদাবাদির উপস্থিতি। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৫

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন