সুরা জুমআ'র প্রাথমিক পরিচিতি ও ব্যাখ্যা
সুরা জুম্আ পবিত্র কুরআনের ৬২ নম্বর সুরা। মদিনায় নাজিল হওয়া এ সুরায় রয়েছে ১১ আয়াত।
এই সুরার কয়েকটি আলোচ্য বিষয় হল: সব সৃষ্টি ও অস্তিত্বের পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রশংসা করা তথা মহান আল্লাহর প্রশংসার সার্বজনীনতা,মহানবী (সা)-কে রাসুল হিসেবে মনোনয়নের উদ্দেশ্য,ইহুদিদের মত মুসলমানরাও যেন সত্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয় সে বিষয়ে হুঁশিয়ারি,মৃত্যু হল পরকালের চিরস্থায়ী জগতে যাবার পথ, জুমা নামাজের গঠনমূলক ভূমিকা এবং জুমা নামাজে অংশ নেয়ার জন্য রুটি-রুজি অর্জনের কাজ বন্ধ রাখা ইত্যাদি।
সুরা জুমআ শুরু হয়েছে মহান আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনার মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহর কয়েকটি নাম ও গুণ স্মরণ করিয়ে দিয়ে সুরা জুম’আর প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে:
'আকাশ ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে তার সবই রাজ্যাধিপতি,সব ত্রুটি ও অপূর্ণতা হতে পবিত্র, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে।'
অন্য কথায় আকাশ ও জমিনগুলোতে যা কিছু আছে তার সবই মহান আল্লাহর গুণগান করছে এবং তিনি যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপূর্ণতা থেকে মুক্ত তা ঘোষণা করছে। তাই এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে মহান আল্লাহর ইবাদত কেবল মানুষের জন্যই সীমিত নয়। সব সৃষ্টিই তার ইবাদত ও প্রশংসা করছে।
সূরা জুমআ'র প্রথম আয়াতে একাত্মবাদ ও মহান আল্লাহর কয়েকটি গুণের দিকে আলোকপাতের পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহর রাসূল হিসাবে নিয়োগ দেয়ার প্রসঙ্গে বক্তব্য এসেছে। মহান আল্লাহ বলেছেন:
'তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছেন,যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতগুলো, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত বা প্রজ্ঞা। এর আগে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।'
মহান আল্লাহ মানুষকে মুক্তি ও সুপথ তথা হেদায়াতের পথ দেখানোর জন্য বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে বেছে নিয়েছিলেন। এ বিষয়টিকে মহান আল্লাহর নিজের প্রজ্ঞা ও সম্মানের প্রকাশ বলে মনে করেন। একইসঙ্গে একজন নিরক্ষর ব্যক্তিকে ইসলামের নবী ও সর্বশেষ রাসুল হিসেবে মনোনয়ন করাকেও মহান আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা বা মু'জিজার নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। পড়াশুনা করেননি এমন একজন মানুষের কাছে পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়া ছিল মহান আল্লাহর আরও এক বড় অলৌকিক নিদর্শন। পবিত্র কুরানের বক্তব্য ও বিষয়বস্তুগুলোর রয়েছে গভীর প্রভাব এবং এই মহাগ্রন্থ মানুষের জন্য সবচেয়ে ভালো পথগুলো দেখায়। তাই কোনো এক ব্যক্তি বা মানবজাতি এমন বই রচনা করতে পারেন না। বিশেষ করে পড়াশুনা করেননি ও পড়াশুনা বা জ্ঞান অর্জনের পরিবেশে বড় হননি এমনি একজন ব্যক্তির মাধ্যমে কোনো আসমানি গ্রন্থ রচনা করার প্রশ্নই ওঠে না।
পবিত্র কুরআন হচ্ছে এমন এক নুর যা মানুষের অন্ধকার অন্তরকে আলো দেয়। আর খোদ এ বিষয়টিও তো একটি অলৌকিক ব্যাপার। পবিত্র কুরআন মুহাম্মাদ (সা)'র রেসালাত ও নবুওতের প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট দলিল তথা নিদর্শন।
মহানবী (সা)-কে দেয়া খোদায়ী দায়িত্ব ছিল মানুষকে সুপথে আনা। আর এই লক্ষ্যে তাঁর কর্মসূচিগুলোর মূলনীতি হল: মানুষের জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ গ্রন্থ কুরআন তিলাওয়াত করা বা তাদেরকে তা পড়ে শোনানো, দ্বিতীয়ত: মানুষের নাফস বা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং তৃতীয়ত: পবিত্র কুরআন ও হিকমাত বা প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়া।
সুরা জুমআ'র এই আয়াতে তথা দ্বিতীয় আয়াতে এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে যে মহান আল্লাহর শেষ নবী ও রাসুল এসেছেন মানুষকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পাশাপাশি নৈতিক এবং বাস্তব বা ব্যবহারিক দিক থেকেও উন্নত করতে যাতে তারা এ দুই পাখার মাধ্যমে সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছে তথা মহান আল্লাহর পথকেই বেছে নেয়। এটা মনে রাখা দরকার যে ইসলামের মহান নবী কেবল নিজ যুগের সেই নিরক্ষর সম্প্রদায় ও মানুষের জন্য নবী ও রাসুল ছিলেন না। তাঁর আহ্বান ছিল সার্বজনীন তথা কিয়ামত পর্যন্ত সব দেশের সব জাতি ও গোত্রের জন্য প্রযোজ্য। তাই সুরা জুমআ'র পরের আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'এই রাসূলকে পাঠানো হয়েছে অন্য আরও লোকদের জন্যে,যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি। তিনি পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।'
তাই এটা স্পষ্ট মহানবীর সাহাবিদের পরও এমন অনেক সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে যারা মহানবীর (সা) আদর্শের আলোকে গড়ে উঠেছিলেন এবং তারা ছিলেন পবিত্র কুরআন ও সুন্নাতের স্বচ্ছ ফল্গুধারায় পরিতৃপ্ত আদর্শ মানব। এইসব মানুষও ছিলেন মহানবীর মিশন ও দাওয়াতের আওতাভুক্ত।
বিশ্বনবী (সা)'র যুগের ইহুদিরা বলত, মুহাম্মাদ যদি আল্লাহর রাসুল বা প্রেরিত পুরুষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েও থাকেন তবুও তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
মহান আল্লাহ বলছেন, ইহুদিরা যদি তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ত ও তা মেনে চলত তাহলে তারা এই কথাটি বলত না। কারণ, তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে শেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মাদ (সা)'র আবির্ভাব হওয়ার সুসংবাদ রয়েছে।
সুরা জুমআ'য় এই শ্রেণীর ইহুদিদেরকে ভারবাহী গাধার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন:
'যাদেরকে তওরাত দেয়া হয়েছিল,এরপর তারা তার অনুসরণ করেনি,তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধার মত,যে কেবলই পুস্তক বহন করে কিন্তু পুস্তকের বক্তব্য থেকে কোনো কল্যাণই অর্জন করে না,তারা আল্লাহর আয়াতগুলোকে মিথ্যা বলে,তাদের দৃষ্টান্ত কত নিকৃষ্ট। আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।'
অন্য কথায় ইহুদিরা কেবল তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়েই যেত, কিন্তু এ ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা করত না। তাই তাদের নির্বুদ্ধিতা হয়েছে প্রবাদতুল্য। এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ বা আসমানি কিতাব বহন করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এসব বইয়ের বক্তব্যকে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করাই বেশি জরুরি ও কল্যাণকর। ইহুদিরা কেবল আসমানি কিতাবের বোঝাই বহন করেছে, কিন্তু তা থেকে মোটেও শিক্ষা নেয়নি। সুরা জুমআ'র এই আয়াতে ইহুদিদের তিরস্কার করা হলেও তা আসলে মুসলমানদের জন্যও সতর্কবাণী। অর্থাৎ মুসলমানদের অবস্থাও যেন এমন না হয় যে তারা কেবলই কুরআনের আয়াত শুনবে, কিন্তু বাস্তবে তার অনুসরণ করবে না! #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ২৩
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন