সুরা মুনাফিকুনের প্রাথমিক পরিচিত ও ব্যাখ্যা
সুরা মুনাফিকুন পবিত্র কুরআনের ৬৩ নম্বর সুরা। মদিনায় নাজিল হওয়া এ সুরায় রয়েছে ১১ আয়াত। কপট বিশ্বাসী বা মুনাফিকদের নিয়ে আলোচনা এ সুরার প্রধান আলোচ্য বিষয়।
সুরা মুনাফিকুনে বক্তব্য এসেছে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য ও তাদের নানা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যাতে মু'মিনরা সতর্ক হতে পারে। এ সুরায় বলা হয়েছে, বস্তুগত নেয়ামতগুলো যেন মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে মু'মিনদের অসচেতন না করে। এ ছাড়া মৃত্যুর আগেই দান-খয়রাত করা যে খুব জরুরি- সেই উপদেশও স্থান পেয়েছে সুরা মুনাফিকুনে।
কোনো ব্যক্তি যদি মনে মনে কাফির হওয়া সত্ত্বেও বাহ্যিকভাবে এটা দেখায় যে সে মুসলমান তাহলে এই ব্যক্তি হচ্ছে বাস্তবে মুনাফিক। এ ধরনের ব্যক্তি নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জন্য কিংবা কাফিরদের কাছে গোপনে স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের জন্যই মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) যখন মদিনায় একটি শক্তিশালী ইসলামী সমাজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন তখনই ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয় মুনাফিক বা কপট মুসলমানদের তৎপরতা। এর আগে মক্কায় মুনাফিকদের অস্তিত্ব ছিল প্রায় শূণ্যের কোঠায়। কারণ সেখানে মুসলমানরা ছিল দুর্বল, প্রবল চাপ ও নির্যাতনের শিকার। কিন্তু ইসলাম মদিনায় ছড়িয়ে পড়ার পর ইসলামের শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এ অবস্থায় প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধিতা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে শত্রুদের একাংশ মুসলমান সেজেই ভেতর থেকে ইসলামের ওপর আঘাত হানার কৌশল খাটাতে থাকে। যে কোনো আদর্শ বা বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার পর দেখা যায় যে শত্রুরা বন্ধু সেজে পেছন থেকে ছুরি মারতে সচেষ্ট হয়। আর তাই এ বিষয়টি স্পষ্ট যে কেনো মুনাফিক সম্পর্কিত আয়াতগুলো মুসলমানদের মক্কী জীবনে নাজিল না হয়ে মাদানি জীবনে নাজিল হয়েছে।
মুনাফিকদের উপদ্রপ কেবল মহানবী (সা)'র যুগেই সীমিত ছিল না। প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক সমাজই এই সংকটের শিকার হতে পারে। তাই সুরা মুনাফিকুনের আয়াতগুলো সব সমাজের ও সব যুগের মুনাফিকদের জন্যই প্রযোজ্য। মুনাফিকদের সাধারণত চেনা যায় না বলে তাদের সৃষ্ট সংকট খুবই মারাত্মক হয়ে থাকে। এরা অনেক সময় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে। তাই মহান আল্লাহ সবচেয়ে কঠোর কথা বলেছেন মুনাফিকদের সম্পর্কে। ইসলাম যুগে যুগে সবচেয়ে কঠিন আঘাত পেয়েছে মুনাফিকদের কাছ থেকে।
সুরা মুনাফিকুনে কপট বিশ্বাসী তথা মুনাফিকদের সম্পর্কে সব কিছুর আগে যে কথা বলা হয়েছে তা হল তাদের ঈমান আনার বিষয়ে মিথ্যাচার। মহান আল্লাহ বলছেন:
'হে নবী! মুনাফিকরা যখন আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে,মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।'
-মুনাফিকদের মুখে মধু থাকলেও অন্তরে রয়েছে বিষ। ভেতর ও বাইরের দ্বিচারিতা এবং মিথ্যাচারিতা মুনাফিকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ওরা মুখে মুখে ইমান আনার কথা প্রচার করে বেড়ায় অথচ তাদের অন্তরে ঈমানের কানা-কড়িটিও নেই। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা. যে মহান আল্লাহর রাসুল – এ বিষয়ে মুনাফিকদের বাহ্যিক সাক্ষ্য মিথ্যা ছিল না, বরং তা ছিল বাস্তব ঘটনা। কিন্তু তাদের এই সাক্ষ্য হৃদয়ের বা বাস্তব-বিশ্বাস-ভিত্তিক ছিল না। এ জন্যই মহান আল্লাহ বিশ্বনবীকে (সা.) সম্বোধন করে বলছেন,আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসুল। কিন্তু তারা তথা মুনাফিকরা যা বলছে তথা দাবি করছে তা মিথ্যাচার মাত্র।
পরের আয়াতে মুনাফিকদের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলছেন:
'তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা যা করছে, তা খুবই মন্দ।'
-মুনাফিকরা সত্য ধর্মের দিকে মানুষের পথ প্রদর্শনে বাধা দেয়। আর এর চেয়ে নিকৃষ্ট ও নোংরা কাজ আর কি হতে পারে? মুনাফিকরা আল্লাহর নামে ও পবিত্র নানা শপথের আড়ালে নিজেদের আসল চেহারা ঢেকে রাখে। তারা মুসলমান সেজে মুসলিম জনগণের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করে। তাই তাদের বাহ্যিক আচরণ, সুসজ্জিত বেশ-ভূষা, আকর্ষণীয় চেহারা ও মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে ধোঁকা খাওয়া উচিত নয়।
মহান আল্লাহ সুরা মুনাফিকুনের চতুর্থ আয়াতে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন:
'(হে নবী!) Bottom of Formআপনি যখন তাদেরকে দেখেন,তখন তাদের (সুসজ্জিত) দেহাবয়ব আপনার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। আর যদি তারা কথা বলে, তবে তা আপনার শুনতেই ইচ্ছে হবে। তারা দেয়ালে ঠেকানো কাঠের মত। প্রত্যেক জোরালো আওয়াজ বা শোরগোলকে নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে তারা। তারাই আসল শত্রু,তাই তাদের সম্পর্কে সতর্ক হোন। ধ্বংস করুন আল্লাহ তাদেরকে। তারা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে ?'
-মুনাফিকদের বাহ্যিক সাজ-সজ্জা ও আচরণ মন-ভোলানো হলেও তাদের ভেতরটা আসলে অন্তঃসারশূন্য। বাহ্যিকভাবে মুনাফিকদেরকে প্রশান্তিদায়ক মনে হলেও বাস্তবে তারা প্রাণহীন মূর্তি। তারা সব সময়ই বিচলিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত। মুনাফিকদের মনে বিন্দুমাত্র আলো ও পবিত্রতা নেই। ঈমান, খোদার ওপর নির্ভরতা, আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্তের অভাবে তাদের মন দেয়ালে-ঠেকানো শুকনো কাঠের মত সবসময়ই নড়বড়ে দোদুল্যমান। তাই তারা যে কোনো উচ্চকিত শব্দকেই নিজেদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত বলে মনে করে। ভয় আর আতঙ্ক তাদের নিত্য-সঙ্গী। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও উৎকণ্ঠার বেড়াজালে মুনফিকদের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে থাকে। একই আয়াতে মহানবীকে (সা) সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে:
এরাই আপনার প্রকৃত শত্রু। তাই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। আরও বলা হচ্ছে যে, সত্য ধর্মের এতসব স্পষ্ট নিদর্শন ও প্রমাণ দেখার পরও মুনাফিকরা সত্য থেকে দূরে রয়েছে। তাই আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন! এরা মুসলিম সমাজে বসবাস করে বলে মুসলমানদের নানা জরুরি ও গোপন তথ্য জানে। অথচ শত্রু হিসেবে এরা চিহ্নিত নয় বলে এদের মোকাবেলা করা খুবই কঠিন। তাই এদের শত্রুতাই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ১৪
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন