অক্টোবর ১৬, ২০১৮ ১৯:২৭ Asia/Dhaka

আপনারা জানেন যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর প্রথমেই মসজিদ নির্মাণ করেন।

এরপর গত ১৪শ’ বছরে এই পবিত্র স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে বহু পরিবর্তন এসেছে। কখনো মসজিদের বাহ্যিক সৌন্দর্য এতটা মোহনীয় করে তৈরি করা হয়েছে যে তা রাজপ্রাসাদকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ইবাদত করার দিক দিয়ে মসজিদ কখনোই তার আবেদন হারায়নি।

ইসলামে একদিকে যেমন বিলাসবহুল জীবনযাপনকে উৎসাহিত করা হয়নি অন্যদিকে অপচয় করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এই ঐশী ধর্ম সাধাসিধে জীবনযাপনকে উৎসাহিত করেছে।  মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে এই সাধাসিধে জীবনযাপন করলেও আল্লাহর ঘর তৈরি করার সময় সেটিকে সাধ্যমতো সুন্দর করে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে আজও দেখা যায় একটি এলাকা বা মহল্লার বেশিরভাগ মানুষের ঘরবাড়ির তুলনায় তাদের মসজিদটি তুলনামূলক উন্নত নির্মাণশৈলীতে তৈরি হয়।

তবে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদ নির্মিত হয়েছে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে এবং তখন খড় দিয়েই সাধারণত মসজিদের ছাউনি দেয়া হতো। আস্তে আস্তে সামনের দিকে খোলা চত্বর এবং পিলারযুক্ত বারান্দাসমৃদ্ধ মসজিদ তৈরি হতে থাকে। এ সময় মসজিদগুলো তৈরি হয় রোদে শুকানো ইট দিয়ে এবং এর পিলারগুলো দেখতে হয় অনেকটা একই রকম। এরপর ধীরে ধীরে মসজিদ তৈরির রীতিতে পরিবর্তন আসে এবং পোড়ানো ইট দিয়ে মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদের পিলারেও আসে বৈচিত্র। এরপর এতে সংযুক্ত হয় টাইলস ও নানা রকমের কারুকার্য। পরবর্তীতে রাজা-বাদশাহরা মসজিদকে তাদের শক্তি ও শৌর্যবীর্জ প্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেন।  তারা মসজিদে বিশাল গম্বুজ ও সুউচ্চ মিনার স্থাপন করতে থাকেন। মসজিদকে কীভাবে আরো জৌলুসপূর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার যায় সেজন্য যুগের নামকরা স্থাপত্যশিল্পীরা তাদের সবটুকু মেধা ও মনন  ঢেলে দেন। ফলে মসজিদ হয়ে ওঠে মুসলমানদের শৈল্পিক সক্ষমতা প্রদর্শনের স্থান।

বর্তমানে মসজিদের স্থাপত্যরীতি মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অংশ হয়ে গেছে। এই স্থাপত্যশৈলীতে ঈমান, আধ্যাত্মিকতা ও ইবাদত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এমনভাবে মসজিদ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে যাতে এর ভেতরে বসে নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করা যায়। বর্তমানে বেশিরভাগ মসজিদ তৈরি হচ্ছে চারকোনবিশিষ্ট। এই নির্মাণশৈলী সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন: “বাইতুল মা’মুরের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে কাবা শরীফকে বর্গাকৃতিতে নির্মাণ করা হয়। বাইতুল মা’মুরও বর্গাকৃতি হয়েছে আল্লাহ তায়ালার আরশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আর আল্লাহর আরশ চতুর্কোণবিশিষ্ট হয়েছে ইসলামের চারটি মূল ভিত্তিকে কেন্দ্র করে। ওই চার ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর চারটি তাসবিহ এবং সেগুলো হচ্ছে সুবহানআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার। ”

মহানবী (সা.) এক হাদিসে বলেছেন: “আমি মে’রাজের রাতে একটি বিশাল গম্বুজ দেখতে পেয়েছি যার রং ছিল সাদা এবং সেটি চারটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত ছিল। সেই চার স্তম্ভের ওপর সূরা ফাতিহার প্রথম চারটি শব্দ অর্থাৎ বিসম, আল্লাহ, আর-রহমান ও আর-রাহিম লেখা ছিল। ” কাজেই আমরা বলতে পারি, আরশে আজিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মসজিদ নির্মাণের স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠেছে।

আসরের এ পর্যায়ে আমরা ভারতের রাজধানীতে অবস্থিত দিল্লি জামে মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।  দিল্লি জামে মসজিদ শুরুর দিকে ‘মসজিদে জাহান নামা’ বা ‘জগতের প্রতিবিম্ব মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। বিংশ শতাব্দির শেষদিক পর্যন্ত এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণকাহিনীতে দিল্লি জামে মসজিদকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ বলে উল্লেখ করেছেন। মোঘল সাম্রাজ্যের অপরূপ এই স্থাপনায় ব্যাপক হারে লাল পাথর, নুড়ি পাথর ও মর্মর পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এই তিন পাথরের সমাহার মসজিদটির শোভা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভারতের দিল্লি জামে মসজিদ

ভারতের সবচেয়ে বড় জুমার নামাজ এই মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় বলে এটির নাম দেয়া হয়েছে দিল্লি জামে মসজিদ। পঞ্চম মোঘল সম্রাট ও তাজমহলের স্থপতি শাহজাহানের নির্দেশে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ নির্মিত হয়। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ১০৬৬ হিজরির ঈদুল ফিতরে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এই মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। দিল্লির পুরনো অংশে এই মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫,০০০ শ্রমিক ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। এটিতে একসঙ্গে ২৫ হাজার মুসল্লি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন।

ভারতের দিল্লি জামে মসজিদ

ভারতে এই মসজিদ ‘মসজিদে জাহান নামা’ নামে পরিচিত। মসজিদটি শুরুতে আকারে ছোট থাকলেও এর জন্য সম্রাট শাহজাহান যে বিশাল জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন পরবর্তীতে তার প্রায় পুরোটা জুড়ে মসজিদটি বিস্তৃত হয়েছে।  ৩১ বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসনকারী সম্রাট শাহজাহানের শিল্প, স্থাপত্য, কবিতা ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। ভারতের কোনো শাসক শাহজাহানের মতো এত বেশি বিশাল ও বিখ্যাত স্থাপনা রেখে যাননি। তাজমহল নির্মাণের জন্য শাহজাহানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও তিনি দিল্লি জামে মসজিদ, দিল্লির লাল কেল্লা, আগ্রা কেল্লার বেশিরভাগ অংশ, লাহোরের উজির খান মসজিদ এবং পাকিস্তানের তেহাটায় শাহজাহান মসজিদ নির্মাণ করেন।

তিনটি বিশাল ফটক সম্বলিত মসজিদটিতে চারটি সাদা গম্বুজ এবং দুটি মিনার রয়েছে।  মিনার দুটির উচ্চতা প্রায় ৪০ মিটার। মিনার দুটির পাঁচটি ধাপে পাঁচটি করে ব্যালকনি রয়েছে, যার প্রথম তিনটি লাল বেলেপাথর, চতুর্থটি সাদা মার্বেল এবং পঞ্চমটি সাধারণ পাথর দিয়ে তৈরি। লাল বেলেপাথর এবং সাদা মার্বেলের স্ট্রাইপ দেয়া মিনার দুটি সূর্যের আলোর তীব্রতা ভেদে রং বদলায়। ঝলমলে সূর্যালোক এবং ভরা পূর্ণিমার সময়ে এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যেকোনো মানুষের হৃদয় কাড়ে। দিল্লি জামে মসজিদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ মিটার।

মসজিদের মেঝে তৈরি হয়েছে সাদা ও কালো মরমর পাথরের মিশ্রনে। প্রতিটি মুসল্লির সিজদার স্থান এই মর্মর পাথর বসিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। এই নামাজের স্থানগুলির প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৯১.৪৪ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৫০ সেন্টিমিটার। মসজিদের মূল চত্বরে এরকম ৮৯৯টি নামাজের স্থান চিহ্নিত করা আছে।

উপমহাদেশের আরো অনেক মসজিদের মতো দিল্লি জামে মসজিদেও ফার্সি শিলালিপি রয়েছে। ভারতে মোঘল শাসনের সময় ইরানে চলছিল সাফাভি রাজবংশের শাসন। এ কারণে এসব শিলালিপিতে তৎকালীন সাফাভি শাসনামলের লেখ্যরীতি চোখে পড়ে। মোঘল সম্রাট শাহজাহান দিল্লি জামে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য উজবেকিস্তানের বুখারা এলাকা থেকে একজন আলেমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। ওই আলেমের নাম ছিল সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারি। দিল্লির জামে মসজিদের ইমাম নিয়োগ দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় ইমাম হিসেবে ঘোষণা দেন সম্রাট শাহজাহান।  এ সময় সৈয়দ বুখারির পদবি দেওয়া হয় ‘শাহি ইমাম’। মুঘল আমলে সম্রাট হওয়ার ব্যাপারে বংশ পরম্পরাকে আদর্শ মনে করা হতো। জামে মসজিদের ইমাম হওয়ার শর্ত হিসেবেও বংশের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল আমলের পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটলেও জামে মসজিদের ইমামদের ক্ষেত্রে বংশ পরম্পরায় ইমাম হওয়ার প্রথা এখনো চালু আছে। বর্তমানে শাহি ইমাম হিসেবে সৈয়দ আবদুল গফুর শাহ বুখারির ১৩তম উত্তরসূরি সৈয়দ আহমেদ বুখারি নিয়োজিত আছেন। #

 

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৬

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ