অক্টোবর ২০, ২০১৮ ১৯:৩৬ Asia/Dhaka

হযরত আলী (আ.) ছিলেন এমন একজন মহান চরিত্রের অধিকারী মানুষ যার প্রশংসা শুধু শিয়া ও সুন্নি আলেমগণই করেননি সেইসঙ্গে প্রখ্যাত খ্রিস্টান পণ্ডিতরাও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন।

মিশরের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও আলেম শেখ আব্দু ‘নাহজুল বালাগা’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন: “আলী ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক যিনি আল্লাহর ইবাদতে রাত্রিজাগরণ করতেন। আল্লাহর ইবাদত করার সময় তার চোখেমুখে থাকত আতঙ্কের ছাপ কিন্তু জিহাদের ময়দানে তিনি ছিলেন হাসিমাখা মুখের অধিকারী। তাঁর ছিল বহুমুখী প্রতিভা। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, খতিব, বিচারক, মুফতি, কৃষক এবং ক্ষুরধার লেখক। সার্বিকভাবে আলী ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।”

হযরত আলী (আ.)-এর জীবনীকে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়। জন্ম থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরত পর্যন্ত সময়, মদীনার মুহাজির জীবনের শুরু থেকে রাসূলুল্লাহর রেহলাত পর্যন্ত সময় এবং এরপর থেকে কুফার মসজিদে শাহাদাতবরণ পর্যন্ত সময়।

 

ইতিহাসে এসেছে, হযরত আলী (আ.)-এর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ যখন নয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন একদিন সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আলামত ফুটে ওঠার পর তিনি ক্বাবাঘরে ছুটে যান এবং একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে থাকেন। তাওয়াফ শেষে দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন, খুব সহজেই যেন তাঁর সন্তানের জন্ম হয় এবং এই সন্তান যেন মানবতার কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারে। একত্মবাদী ও মুত্তাকি এই নারী এভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন: “হে আল্লাহ! আমি আপনার একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং আপনার নবী-রাসূলদের মাধ্যমে যত কিতাব পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার সবগুলোর প্রতি আমার ঈমান রয়েছে। মানবতার মুক্তির জন্য যত নবী-রাসূল আপনি পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তাদের সবার প্রতি আমার গভীর বিশ্বাস রয়েছে। আমার গর্ভে আপনি যে সন্তান দান করেছেন এবং যার এখন ভূমিষ্ট হওয়ার সময় হয়ে গেছে তার জন্মকে আপনি আমার জন্য সহজ করে দিন। ”

ফাতিমা বিনতে আসাদ এই দোয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে কাবাঘরের প্রাচীর ফেটে দরজা তৈরি হয়ে যেতে দেখেন এবং খোদায়ী ইশারা মনে করে তিনি প্রাচীরের সেই ফাঁক দিয়ে আল্লাহর ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তিনি কাবাঘরে প্রবেশ করার পর প্রাচীরের সেই প্রবেশপথটি আবার আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আল্লাহর ঘরের ভেতরেই ফাতিমা বিনতে আসাদের শিশুসন্তান ভূমিষ্ট হয়।

  

হযরত আলী (আ.)-এর জন্মের এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার তিনদিন পরের কথা। এই তিন দিনে ফাতিমা বিনতে আসাদের কাবাঘরে প্রবেশের কাহিনী গোটা মক্কায় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি কাবাঘরের ভেতরে আটকে আছেন এবং বাইরে থেকে আল্লাহর ঘরের দরজা খোলার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। হঠাৎ এই একত্ববাদী নারী তাঁর শিশুসন্তানকে নিয়ে প্রাচীরের যে অংশ দিয়ে ক্বাবাঘরে প্রবেশ করেছিলেন সেখান থেকেই বেরিয়ে আসেন।

এই আড়ম্বরপূর্ণ মুহূর্তে আবুতালেব নিজের স্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ছুটে আসেন, তাকে অভিনন্দন জানান এবং নিজের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে চুমু খান ও বুকের সঙ্গে আগলে ধরেন। ঠিক এ সময় বিশ্বনবী (সা.)ও সেখানে পৌঁছে যান এবং নবজাতককে কোলে নেন, তাকে চুমু খান এবং এই মহান ব্যক্তিত্বকে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করেন।

হযরত আলী (আ.) শিশুকাল থেকেই বিশ্বনবী (সা.)-এর অনুগামী ছিলেন। মক্কায় একবার খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে আবুতালেব অর্থনৈতিকভাবে শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। বিশ্বনবী (সা.) এ অবস্থায় চাচা আবুতালেবকে সাহায্য করার জন্য আলী (আ.)কে নিজের কাছে নিয়ে প্রতিপালন করার প্রস্তাব দেন। আবুতালেব এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। এভাবে আল্লাহর ইচ্ছায় শিশুকাল থেকেই হযরত আলী (আ.) বিশ্বনবী (সা.)-এর হাতে লালিত পালিত হতে থাকেন।

এ সম্পর্কে আমীরুল মুমিনিন তাঁর এক খুতবায় বলেন: “বিশ্বনবী (সা.) কোলেপিঠে করে আমাকে বড় করেছেন, বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন এবং নিজের বিছানায় আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি যখন আমাকে কোলে নিতেন তাঁর শরীরের সুঘ্রাণ আমার নাকে এসে লাগত। শক্ত খাবার তিনি চিবিয়ে নরম করে একটু একটু করে আমার মুখে পুরে দিতেন। আমার মুখে তিনি কোনোদিন মিথ্যা কথা শোনেননি এবং আমাকে কোনো ভুল করতে দেখেননি। আমি সব সময় তাঁর আনুগত্য করতাম। এভাবে ধীরে ধীরে বিশ্বনবীর উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী আমার মধ্যে প্রকাশ পেতে থাকে।”

রাসূলের ঘরে বড় হয়ে ওঠার এই দিনগুলি এক সময় শেষ হয়ে যায়। বিশ্বনবী (সা.) হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর পক্ষ থেকে জিব্রাইল আমিনের মাধ্যমে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। সে সময়ের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আলী (আ.) বলেন: “প্রথমদিকে আল্লাহর রাসূল ও বিবি খাদিজা যে ঘরে বসবাস করতেন সেই ঘর ছাড়া মক্কার আর কোনো ঘরে ইসলামের আলো প্রবেশ করেনি। আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ওহীর মর্ম উপলব্ধি করে মুসলমান হয়ে যাই। ”

এভাবে বিশ্বনবীর পর হযরত আলী (আ.) ছিলেন প্রথম পুরুষ যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার পর প্রথম হাতে গোনা যে কয়েক ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেন আমি তাদের অন্যতম। আমি প্রথম পুরুষ যে বিশ্বনবীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছি।” হযরত আলী (আ.)-এর এই মহা সাফল্য সম্পর্কে আল্লার রাসূল (সা.) বলেন: আলী হচ্ছে প্রথম ব্যক্তি যে আমার রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে।  কিয়ামতের দিন তার সঙ্গেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ হবে এবং সে আমার হাতে নিজের হাত সঁপে দেবে। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ২০

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন