নভেম্বর ১১, ২০১৮ ২১:১৩ Asia/Dhaka
  • বিশ্ব-বিশ্রুত ইরানি কবি রুমির জীবন ও কর্ম

অস্তিত্ব-জগতের ঐক্য বা ঐকতানসহ বিশ্ব ও সৃষ্টি জগতের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক, মানুষের উন্নয়ন, পরিণতি ও পূর্ণতা বিষয়ক বক্তব্য এমন কিছু মৌলিক বিষয় যা রুমির কবিতাকে করেছে চিন্তা-উদ্দীপক ভাবধারায় সমৃদ্ধ। ঈদের সময় নতুন পোশাক যেমন দেয় নতুনত্বের আনন্দ তেমনি নানা মৌলিক বিষয়ে রুমির নতুন নতুন কথাও মানুষকে দেয় নবীনতার অনন্য স্বাদ ও চিরসজীবতার তৃপ্তি।

অন্য কথায় ফার্সি কাব্য সাহিত্যে রুমির তাজা বক্তব্য এনেছে নতুন ঈদের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস ও আনন্দের সুর-লহরী। তাই রুমির কবিতা বার বার পড়েও কেউ কখনও ক্লান্ত হয় না, বরং সব সময়ই এসব কবিতা মানুষের মনে জোগায় সতেজ হওয়ার অনুভূতি। রুমির কাব্যগুলো যেন তার সমৃদ্ধ চিন্তাধারাবাহী এক বিশাল সাগর। প্রবাহমান এ সাগরে সব সময়ই যে কোনো যাত্রী বা নাবিক খুঁজে পান মনি-মুক্তাসহ নানা নতুন সম্পদ। মাওলানা রুমির চিন্তা ও বক্তব্যগুলো কোনো বিশেষ সময়ের গণ্ডীতে আবদ্ধ নয়। তাই সেগুলো হয়েছে কালোত্তীর্ণ ও চিরন্তন।

ডক্টর জাররিনকুবের মতে রুমির গজলের রয়েছে বিশেষ সুর। রুমি যখন বলে যান তখন যেন তিনি কাব্য রচনার কথা যেন মাথাতেই রাখেন না এবং তার কথার মালায় থরে থরে ঝরে পড়ে সুবিন্যস্ত চিন্তাধারা কল্পনার নানা চাদর হতে। আর এসবই আপনা আপনিই রূপ নেয় গজলে ও কবিতায়। তার চিন্তার তুফানের সঙ্গে ছুটে চলে ছন্দ ও শব্দ বিন্যাসের বন্যা। আর এ দুটিই পরস্পরকে যেন আকর্ষণের মালায় গেঁথে রাখে স্বতস্ফূর্ত ভাবে।

রুমির হাতে শব্দগুলো যেন গলিত লোহার টুকরোগুলোর মতই কিংবা রংবেরংয়ের পাথরের নুড়ি দিয়ে তৈরি-করা মোজাইক-টাইলসের মতো  নতুন নানা আকৃতি নিয়ে  অপরূপ এবং অভূতপূর্ব নানা যৌগিক শব্দ ও বাগধারায় রূপ নিয়েছে। অধ্যাপক ফুরুজানফারের মতে মাওলানা রুমি তার গজলগুলোতে ৭৫ হাজারেরও বেশি বিশেষণমূলক নতুন যৌগিক শব্দ রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তার সৃষ্টিশীল চিন্তা ও নতুন শব্দ রচনার বিস্ময়কর শক্তি।  

ফার্সি শব্দ ব্যবহারে রুমির অসাধারণ নৈপুন্য তার  উচ্চতর চিন্তা ও বিশাল আত্মাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। রুমির নির্বাচিত শব্দাবলী মৌলিক ও মানবীয় বাস্তবতার শক্তি প্রকাশের সাক্ষ্য বহন করে।

পাশ্চাত্যের কোনো এক কবি বলেছেন, কবিতা-জগতে তা-ই মধুরতম হয় যা মানুষের বেদনার কথা বলে। রুমির কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে রুমির দিওয়ানে শামস তাব্রিজি কাব্যের গজলগুলোয় বিধৃত হয়েছে হৃদয়-জুড়ানো করুণ রসের অপূর্ব আস্বাদ। রুমির কাব্য দিওয়ানে শামস ফার্সি গজল সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ।

ঐতিহাসিক জুল আল আফলাকির মতে রুমির শ্রেষ্ঠ বেদনা-বিধুর কবিতাগুলো রচিত হয়েছে শামস তাবরিজিকে হারানোর বিরহ-ব্যাথাকে কেন্দ্র করে। রুমির আধ্যাত্মিক গুরু শামস সূর্যের মতোই যেন প্রজ্জ্বোল হয়ে আছেন তার প্রিয় শিষ্য রুমির কবিতায়। বাস্তব জগত থেকে শামস হারিয়ে গেলেও তাকে চিরকালের জন্য হাজির করে রেখেছেন রুমি তার কবিতায়। মাওলানা রুমি লিখেছেন:

তাবরিজের কি গৌরব শামসের দীপ্ত মুখচ্ছবি

আলোক বিকীর্ণ করা কি উজ্জ্বল তেজোদীপ্ত রবি

সে সূর্যের আশপাশে অজস্র মেঘের আনাগোনা

যেন সে হাজার আত্মা খুঁজে ফিরে আলোকের কথা

শামসকে হারানোর বিরহের পাশাপাশি গজল বা গীতি-কবিতার  মধ্য দিয়ে রুমি ফুটিয়ে তুলেছেন মহাসত্য তথা খোদা থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতার দুঃখ।

সত্যের আলোয় অবগাহন করে নিজেকে পবিত্র করা যায় এবং সেই আলোই হচ্ছে খোদা-প্রেম। আর এই প্রেম-সত্যই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে রুমির সমগ্র কবিতায়।

রুমির দিওয়ানে শামসে তাবরিজি কাব্যে রয়েছে ৪০ হাজার গীতি-গাঁথা। এসব কবিতাই আধ্যাত্মিক প্রেম সম্পর্কিত। আর এসবের ভাষাও বেশ সহজ-সরল ও সাবলিল। 
এক আল্লাহয় বিশ্বাসী রুমির কাব্য-ভাবনায় ফুটে ওঠে বরহাক্ব বা চিরসত্যকে পাওয়ার সাধনা। চিরসত্যের এই সাধনায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই খোদাপ্রেমিক যুক্ত হতে পারেন আল্লাহর সঙ্গে। রুমি তাঁর গুরু শামসই তাব্রিজির মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন চিরসত্যের সঙ্গে তার লীন হওয়ার আকুতির ব্যথা। 

 

খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনাই যে মানুষের প্রধান বেদনা হওয়া উচিত রুমি তা ফুটিয়ে তুলেছেন তার নানা কবিতায়। মসনভি কাব্যে তাই তিনি লিখেছেন:

বাঁশীর আওয়াজ শোনো, করুণ কাহিনী তার সুরে-

বিয়োগ-ব্যথার কথা সেই সুরে আসে ঘুরে ঘুরে।

বাঁশিটি বলছে, ‘আহা আমাকে তো কেটে বাঁশ থেকে

মানব দুঃখের কথা সুর তোলে বলে একে একে।

ছেঁড়া খোঁড়া এ হৃদয়ে বিদায়ের সকরুণ সুর-

প্রেমের রহস্য করে উন্মোচিত-বিয়োগ-বিধুর।

মূল থেকে চলে এসে, মূলে ফিরে যাবার ইচ্ছায়

এমন সুখ ও দুঃখ সুরের ভেতরে বাজে হায়!’

সবাই ধারণা করে সে আমার আপন আপন-

কেউ তো বলে না আহা, আমার এ রহস্য গোপন!

বাঁশীর করুণ সুর বায়ু নয়, দীপ্ত অগ্নি শিখা-

এ আগুন যার না আছে; মিশে যাবে। অগ্নির দাহিকা

সেই তো প্রেমের গতি সুর-মাঝে ছুটে চলে, চলে ...

 

আসলে বাঁশির মুখ দিয়ে রুমি যেন এটাই বলতে চেয়েছেন, আমরা আর কতকাল নিজ বাড়ি তথা আসল বাড়ি থেকে দূরে থাকবো? যে বাসস্থান হলো মহান আল্লাহর সান্নিধ্য বা নৈকট্য-লাভ। আর আসমানি সেই নৈকট্য ফিরে পাওয়ার জন্যই মানুষকে সাধনা করতে হবে এ পার্থিব জগতেই।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/  ১১

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন