ডিসেম্বর ০৯, ২০১৮ ২১:৪৪ Asia/Dhaka

আমরা মওলানা রুমির জীবন ও কর্ম এবং তাঁর কবিতা বা সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তুসহ এসব সাহিত্যের, বিশেষ করে তার কাব্য মসনভির কিছু মৌলিক উপাদানের দিকে ইঙ্গিত করেছিলাম।

সপ্তম হিজরি বা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের প্রখ্যাত মরমি কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি ফার্সি সাহিত্য ও সুফি ধারার সাহিত্য জগতের এক অমর এবং অনন্য নক্ষত্র। বিশ্ববিশ্রুত এই কবির অমর কাব্য মসনভি বা মসনভি শরিফ চিরনতুন ও চিরসজীবতায় ভরপুর ফার্সি সাহিত্য-কর্ম।

রুমির মসনভির গল্পগুলোতে কাল্পনিক, বাস্তব, প্রেমময়, আধ্যাত্মিক বা প্রতীকি শিক্ষামূলক, রহস্যময়, রূপক, উপদেশবাচক এবং কুরআনের কাহিনী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কাহিনীসহ নানা ধরনের কাহিনী রয়েছে। বিশেষ করে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার এক অনন্য খনি বলা যেতে পারে মসনভিকে।

রুমি সব সময়ই মানুষকে দিতে চেয়েছেন অসাধারণ ও নতুন কিছু চিন্তার খোরাক। যা সহজেই জানা যায় না বা দুর্লভ তা-ই ছিল রুমির আরাধ্য। আর এ জন্যই মসনভি হয়ে উঠেছে জ্ঞানের অনন্য রত্ন-খনি।  জ্ঞানগর্ভ বিষয়কে নিজস্ব স্টাইল বা ঢংয়ে পরিবেশন করে তা পাঠকের স্মৃতির মনিকোঠায় অক্ষয় ও চিরস্থায়ী করতে সফল হয়েছেন রুমি।

এবারে রুমির কবিতা থেকে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ ও গভীর শিক্ষামূলক দর্শনে সমৃদ্ধ গল্প তুলে ধরছি: একজন ধর্মীয় উপদেশদাতা বক্তার ছিল এক অদ্ভুত অভ্যাস৷ তিনি যখনই বক্তৃতার মঞ্চে বা মিম্বারে যেতেন তখন সবসন্ত্রাসী,ছিনতাইকারী আর চোর-ডাকাতের জন্যে দোয়া করতেন৷ তিনি আল্লাহর কাছে বলতেন তাদেরকে যেন তিনি সুস্থতা দেন এবং তাদেরকে যেন আল্লাহর রহমত পাবার তৌফিক দেন৷ এই বক্তাকে জিজ্ঞেস করা হলো হে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব! আপনি কেন কেবল চোর-ডাকাত আর দুর্নীতিবাজদের জন্যেই দোয়া করেন? কেন ভালো মানুষদের জন্যে কখনো দোয়া করেননা? ঐ বক্তা বললেন-এর কারণ হলো আমি এইসব মন্দ লোকদের মন্দ কাজ থেকে ভালো অনেক গুণের দিকে আকৃষ্ট হয়েছি৷ আমি যখনি পার্থিব জগতের কোনো স্বার্থের জালে বা ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম তখনই তারা আমাকে সেই দুনিয়াবী স্বার্থ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে৷ অর্থাৎ তারা আমার মালামাল ছিনিয়ে নিয়েছে,ঈর্ষার কারণে আমার খ্যাতিকে ম্লান করে দিয়েছে,আমার স্বার্থে আঘাত হেনেছে৷ এইসব কারণে আমার আকাঙক্ষা এখন স্বল্প,আমার চাওয়া-পাওয়াও এখন সীমিত৷ এক ধরনের পরিমিতি বোধ এবং অল্পে তুষ্টির চেতনা আমার মধ্যে এসেছে ৷

মাওলানা রুমি এই গল্প বলার পর বান্দাদের দোয়া এবং আল্লাহর রহমতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন৷ একইসাথে পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, আল্লাহর বান্দারা যখন দুঃখ-কষ্টের শিকার হয় তখন আল্লাহর অনুগ্রহ এবং রহমতের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে৷ মানুষ যতোক্ষণ না বিপদের মুখোমুখি হয় এবং সেই বিপদ থেকে রক্ষা পায়, ততোক্ষণ আল্লাহর অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না৷

 

আসলে প্রত্যেক ক্রিয়ারই যেমন বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে তেমনি মন্দ কাজের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হল  মঙ্গল, কল্যাণ ও সত্যের দিকে মানুষের আকর্ষণ। যেমন, অনেকেই বলেন টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা বা এক-এগারোর ঘটনা ঘটানো হয়েছিল ইসলামের বদনাম করার জন্য। কিন্তু ইসলামের ব্যাপক বদনামের প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আরও বেশি ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। মানুষের বিবেক সব সময়ই সত্যমুখি।

প্রকৃতিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সততার প্রতি রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। কিন্তু ব্যাপক পাপাচার ও পাপের চক্রে অবিরাম জড়িয়ে পড়ার কারণে পাপী মানুষের বিবেকের কার্যকারিতা লোপ পায়। কিন্তু যারা সত্য সন্ধানী তারা পাপীদের মন্দ কাজ থেকেও নিজেদের জন্য কল্যাণের শিক্ষাটিই নিয়ে থাকেন। আর এ জন্যই লোকমান হাকিমকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে কিভাবে আদব কায়দা শেখা যায়? তিনি উত্তরে বলেছেন,আদব-কায়দা শেখো বেয়াদবদের কাছ থেকে। অর্থাৎ বেয়াদবদের কাজের উল্টোটাই হলো শিষ্ঠাচার। ঠিক তেমনি চোর-ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের অতিরিক্ত পাওয়ার বাসনা বা লোভ-লালসার বিপরীতে চলাটাই হল পরিমিতিবোধ এবং অল্পে-তুষ্টি।  

মসনভির গল্পগুলোর আরেকটি বিভাগ হলো কুরআনের গল্প৷ নৈতিক নীতিমালা, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিকতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মাওলানা রুমি কুরআনের নানা গল্পকে বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করেছেন৷ এ ধরনের কয়েকটি গল্পের মধ্যে হুদ ও আদ জাতির গল্প, সাবাবাসীর গল্প এবং মূসা ও ফেরাউনের কাহিনী৷ এরকম শ্রেণীবিন্যাসের পরও রুমি বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মসনভির গল্পগুলোকে রূপকধর্মী গল্প বলেই মনে করেন৷  রূপকধর্মী গল্পগুলোতে বাহ্যিক কাহিনীর আড়ালে অন্তর্নিহিত অর্থ লুকিয়ে থাকে৷ ফলে মসনভির গল্পগুলোর দুটি অর্থ রয়েছে৷ রুমি মূলত অন্তর্নিহিত অর্থের উদ্দেশ্যেই গল্পগুলোর অবতারণা করেছেন৷


মসনভির রূপকধর্মী গল্পগুলোকে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা যায়৷ প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে নীতিকথা বা উপকথা জাতীয় গল্প৷ এ ধরনের গল্পে রূপকথার মতো অলীক বা অপ্রাকৃতিক কথাবার্তাও থাকে৷ যেমন এখানে গাছ কথা বলে,পশুপাখি কথা বলে অর্থাৎ যেসব বস্তু বা প্রাণী কথা বলতে পারে না,তারাও কথা বলে৷ তবে এ জাতীয় গল্পগুলোতে মানুষের বা মানব সমাজের জায়গায় পশুপাখিকে বসানো হয়৷ যেমন বাঘ ও খরগোশের কাহিনী, সিংহ ও উটের গল্প ইত্যাদি৷

রুমির মসনভির রূপক গল্পগুলোর অন্য শ্রেণীটি হলো মানবীয় অর্থাৎ নীতি বা উপদেশমূলক রূপক গল্প৷ স্পর্শকাতর কিছু উদাহরণসহ এ জাতীয় গল্প লেখা হয় যার মাধ্যমে শ্রোতা বা পাঠকদেরকে বৃহৎ কোনো নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়৷ যেমন "মুদি দোকানদারও তোতা" পাখির গল্প৷

 

মসনভির গল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট হলো মূল গল্পের শিরোনাম হিসেবে গল্পটির কিছু প্রধান অংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বা ইশারা দেয়া যা পুরো গল্পের জন্য বিজ্ঞাপনের কাজ করে। এই ধারাটি অবশ্য ইরানে অতীতেও ছিল। এরফলে পাঠক পুরো গল্পের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয় এবং গল্পের ভেতরে ঢুকতে বাধ্য হয়।  #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/  ৯

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন