জালাল উদ্দিন রুমির দু'টি বিখ্যাত গল্প
গত কয়েক আসরে আমরা মওলানা রুমির জীবন ও কর্ম এবং তাঁর কবিতা বা সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তুসহ এসব সাহিত্যের নানা উপাদান, বিশেষ করে তার বিশ্বখ্যাত কাব্য মসনভির কাহিনীর বিষয়বস্তু, স্টাইল ও শ্রেণী-বিন্যাস সম্পর্কে কথা বলছিলাম। আজও আমরা এ বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলবো এবং রুমির দু-একটি গল্পও।
আমরা বলেছিলাম রুমির মসনভির গল্পগুলোতে কাল্পনিক, বাস্তব, প্রেমময়, আধ্যাত্মিক বা প্রতীকি শিক্ষামূলক, রহস্যময়, রূপক, উপদেশবাচক এবং কুরআনের কাহিনী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কাহিনীসহ নানা ধরনের কাহিনী রয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মসনভির গল্পগুলোকে বিষয়বস্তুগত দিক থেকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন৷ যেমন আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক গল্প, শিক্ষামূলক গল্প, কুরআনের গল্প এবং রূপকধর্মী গল্প৷ তবে বিষয়বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে মাসনাভির বেশিরভাগ গল্পই আধ্যাত্মিক।

রুমির দৃষ্টিতে গল্পের দুটি দিক আছে৷ একটি হলো তার দেহ অপরটি আত্মা। গল্পের দেহ হলো তার রচনা কৌশল যার ব্যাপারে রুমির তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। তবে গল্পের আত্মার দিকে তথা গল্পের ভেতরের লুকিয়ে থাকা তাৎপর্যের দিকে তাঁর ছিল গভীর মনোযোগ। তাৎপর্যের দিক থেকে রুমির গল্পগুলো গভীর আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর। গল্প বা কাহিনী ছিল মৌলাভির আধ্যাত্মিকতার দর্শন প্রকাশের অন্যতম মূল উপাদান ৷
হযরত মুসা ও রাখালের গল্প আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক রুমির মসনভির একটি বিখ্যাত গল্প। সংক্ষেপে গল্পটি হলো:
একদিন হযরত মূসা ( আ ) একটি মরুপ্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় তিনি দেখলেন যে এক রাখাল আল্লাহকে সম্বোধন করে বলছে: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার বাসার ঠিকানাটাও দাও। আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। তোমার দুঃখ-কষ্টে আমি তোমার সমব্যথী হতে চাই। আমার সমগ্র জীবন আমার সকল সম্পদ তোমার জন্যে উৎসর্গীত। তুমি তো সেই সত্তা! আমার মেষগুলোর জন্যে যেসব গান গাই সেসব তো তোমারই জন্যে।
হযরত মূসা ( আ. ) এসব কথা শুনে রাখালকে ধমক দিয়ে বললেন : তুমি আল্লাহর সাথে যেভাবে কথা বলছিলে তা তো কুফুরির শামিল। তুমি যদি তোমার এ ধরনের কুফুরি কথাবার্তা বন্ধ না করো,তাহলে আল্লাহর গযব এসে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। সতর্ক হও। তুমি মানুষের পার্থিব গুণাবলীকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর গুণাবলীর সাথে মিলিয়ে ফেলছো। অথচ আল্লাহ এইসব গুণাবলীর অনেক উর্ধ্বে অবস্থান করেন এবং আল্লাহ তোমার সেবার মুখাপেক্ষী নন।
হযরত মূসার তিরস্কার শুনে ঐ রাখাল যুবকের মনটা ভেঙ্গে গেল। সে খুবই কষ্ট পেল। মূসা ( আ ) এর কাছে সে তার অনুতাপের কথা জানালো। এমন সময় মূসা নবীর ওপর আল্লাহর ওহী নাযিল হলো। আল্লাহ বললেন : হে মূসা! কেন তুমি আমার বান্দাকে রাগের সুরে কথা বলে ভয় পাইয়ে দিয়েছো। কেন তুমি তাকে আমাদের দয়া ও অনুগ্রহের ব্যাপারে হতাশ করেছো। আমরা তো কখনোই সৃষ্টিকূলের বাহ্যিক দিক দেখে বিচার করি না। বরং মানুষের ভেতরটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ,কেননা ভেতরটাই হলো তাদের প্রেম-ভালোবাসা আর প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার চিত্ররূপ। হে মূসা ! যে দলটি আমাদেরকে ভালোবাসে,আমরা যাদের প্রিয় এবং কাম্য,তাদের অন্তরটা তো পোড়া,তারা প্রিয় বিরহে কাতর। তারা তাদের মতো করে আমাদেরকে যেভাবে চিনেছে বা বুঝেছে,সেভাবেই তারা আমাদেরকে ভালোবাসে। কাবা শরীফের ভেতরে ঢুকলে যেমন আর ডান-বামের পার্থক্য থাকে না, যে-কোনো দিকে ফিরেই নামায পড়া হোক না কেন, আমাদের দিকেই ফেরা হয়,তেমনি খালেস এবং প্রেমিক বান্দাদের জন্যেও এ ধরনের বিশেষ কিছু ব্যাপার। তারা যে ভাষায় বা যে শব্দসহযোগেই ইবাদাত করুক না কেন কিংবা তাদের মনের কথাগুলো প্রকাশ করুক না কেন,সে সবই পবিত্র এবং পছন্দনীয়।
আল্লাহর পক্ষ থেকে এইসব কথা শোনার পর ঐ যুবক মেষ পালকের কাছে গিয়ে মূসা ( আ ) বললেন, আল্লাহ তোমার ভালোবাসা,কান্নাকাটি আর রহস্যময় কথাবার্তাগুলো শুনেছেন। তোমার ভালোবাসা, তোমার ঈমান এবং তোমার একনিষ্ঠতায় তিনি খুশি। তুমি যেভাবেই আল্লাহর সাথে কথা বলতে চাও সেভাবেই কথা বলো। তুমি এখন আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী এবং তুমি সত্যে উপনীত হয়েছো। রাখাল বললো, আমি এই ছোট্ট এবং নশ্বর পৃথিবীর উর্ধ্বে উঠে কেবল আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন রয়েছি।
এ গল্পটিতে যে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হলো,সত্যের অন্বেষণে কেউ যদি আন্তরিকতার সাথে,নিষ্ঠার সাথে মনোনিবেশ করে তাহলে বাহ্যিক কোনো নিয়ম-নীতির কাঠামো তার জন্যে অবশ্য পালনীয় নয়। একনিষ্ঠ অন্তর নিয়ে আল্লাহর সাথে সাদামাটা বা নিজের ভাষায় নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা বলা যায়। মোট কথা হলো পবিত্রতা ও আন্তরিকতা আল্লাহর সান্নিধ্য বা সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। প্রকৃত প্রেম নির্দিষ্ট স্থান বা সীমার উর্ধ্বে। প্রকৃত প্রেমিক যারা তারা আল্লাহর ভালোবাসায় নিমজ্জিত। আর এ বিষয়টিই মাওলানা রুমি তাঁর গল্পে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
একজন ব্যাকরণবিদ সমুদ্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নৌকায় চড়লো। লোকটি ছিল সংকীর্ণমনা এবং অহংকারী। সে নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করলো- আচ্ছা, তুমি কি আরবী ব্যাকরণ পড়েছো? নৌকার মাঝি ব্যাকরণবিদের প্রশ্ন শুনে বুঝতে পেরেছিল যে সে তাকে অপমান করতে চায়। এটা বুঝতে পেরেও বললো-না, আমি আরবি ব্যাকরণ পড়িনি। ব্যাকরণবিদ যাত্রী এই উত্তর শুনে মাঝিকে বললো-তোমার জীবনের তো অর্ধেকটাই বৃথা। একথা শুনে মাঝির মনে মনে কষ্ট পেলেও বোকা লোকটির সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে নীরব রইল। হঠাৎ সমুদ্রে ঝড় উঠলো। প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে নৌকা দুলতে লাগলো। জাহাজ দুলতে দুলতে যখন ডুবে যাবার উপক্রম, তখন মাঝি ঐ ব্যাকরণবিদকে জিজ্ঞেস করলো- তুমি কি সাঁতার জানো? এখন কি সাঁতার কেটে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারবে?'ব্যাকরণবিদ ভয়ে আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললো- না,আমি সাঁতার জানি না। মাঝি এবার ব্যাকরণবিদকে বললো, আমি আরবী ব্যাকরণ না জানায় আমার জীবন অর্ধেকটাই ব্যর্থ হয়ে গেল, এখন তো দেখছি সাঁতার না জানার কারণে তোমার পুরো জীবনই ব্যর্থ। রুমি এই গল্পের মাধ্যমে মানুষকে অজানা জ্ঞান শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। অজানা জ্ঞান বলতে রুমি বোঝাতে চেয়েছেন বিনয়, বাস্তব দৃষ্টি, আমিত্ব ও অহমিকাহীনতার শিক্ষাকে। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৬
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন