সুস্থ পরিবার (পর্ব-১৯) : অবসরকালীন কর্মসূচি ও করণীয়
গত আসরে আমরা আলোচনা করেছিলাম একটি সুস্থ পরিবারের জন্য অবকাশ যাপন বা ছুটির অবসরকে কাজে লাগানোর গুরুত্ব নিয়ে। মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক সুস্থতার ওপর এই ভ্রমণের ইতিবাচক প্রভাব কতোটা পড়ে সে বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলাম।
আরও বলেছিলাম, সফরকালে সুন্দর ও ঐতিহাসিক কোনো স্থানের ছবি তুলতে ভুল যেন না হয়। যারা ভ্রমণ করে তারা বিচিত্র এলাকার সংস্কৃতি,প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য,বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের নতুন নতুন চিন্তাদর্শ, আচার-প্রথা ইত্যাদি সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পায়। ভ্রমণকারীর চিন্তাচেতনা ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধতর হবার ক্ষেত্রে সফরের ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা ও প্রভাব পড়ে। হাদিসে এসেছে:"সফরে হয়তো কোনোরকম অর্থ অর্জিত হবে না,তবে চিন্তা ও বিশ্বাস অনেক বৃদ্ধি পাবে"। আজ আমরা আলাপ করবো চাকুরি থেকে অবসরকালীন কর্মসূচি ও করণীয় নিয়ে। কারণ এ সময়টায় যথার্থ পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হলে ব্যক্তির নিজের, পরিবারের সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
বার্ধক্যকে আগে শারীরিক অবস্থা দেখে নির্ধারণ করা হতো, বয়সের হিসেব কষে নয়। অবশ্য সে সময় বয়সের হিসেব মোটামুটি অজানাই ছিল বলা চলে। কিন্তু বর্তমানে বার্ধক্য একটি আইনি পরিভাষা। যে বয়সটিকে বার্ধক্য বলে নিরূপণ করা হয় সে বয়সটি হলো পেশাগত দায়িত্ব মানে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করা এবং পেনশন কিংবা অবসরভাতা গ্রহণ করার সময়। তবে ব্যক্তির অবসরকালীন জীবনে একটা মারাত্মক ফাঁক সৃষ্টি হয় যা পূরণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যিনি এই অবসরকালকে একটি সুন্দর সুযোগ বলেও মনে করেন তার কাছেও জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। অবসরকালীন জীবন একেবারেই ভিন্নরকম। যিনি অবসরে যান তিনি অবসরে যাবার বেশ কিছু সময় আগে থেকেই এক ধরনের মানসিক চাপের মুখে পড়েন।
তবে যদি এভাবে ভাবা হয় যে এটিও জীবনেরই একটি অনিবার্য অধ্যায় তাহলে অবসরে যাবার বিষয়টির একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। আলি আকবার দেহখোদা একজন ইরানি মনীষী। তিনি তাঁর লেখা অভিধানে অবসর অর্থাৎ রিটায়ারমেন্টের অর্থ করেছেন পুনরায় উঠে দাঁড়ানো বা নতুন জীবন লাভ করা। অবসরে যাওয়া কোনো ব্যক্তি যদি এই সত্যটিকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারেন তাহলে সত্যিই তিনি তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়টিকে সুন্দরভাবে, আনন্দ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কাটাতে পারেন। সারাজীবনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে তিনি অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে অবসর জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে পারেন। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম।
ব্রিটিশ বিখ্যাত দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল তাঁর নব্বুইতম জন্মদিনে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ওই প্রবন্ধে তিনি বার্ধক্য সম্পর্কে লিখেছেন: বার্ধক্যের সৌন্দর্য যেমন রয়েছে তেমনি ত্রুটিও রয়েছে। ত্রুটিটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এই স্বাভাবিকতা আকর্ষণীয় নয়। তবে তাঁর সৌন্দর্য অনেক। কেননা তার জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যাপক। আমি এমন মানুষের জীবনও দেখেছি যে যৌবনে বা তরুণ অবস্থায় ছিল বেশ কর্মক্ষম কিন্তু তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাকে দিয়ে হয় নি। বুড়ো বয়সে অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পেরেছে যে তার কী করা উচিত।
বার্ধক্য বা অবসরকালীন জীবনের গুরুত্ব কিন্তু অন্যান্য জীবন পর্বের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে বহু মানুষ তাদের জীবনের বৃহৎ সাফল্যগুলো অর্জন করেছে বৃদ্ধ বয়সে। গুণীদের অনেকেই এই বার্ধক্যে এসেই নিজেদের জ্ঞান ও উদ্ভাবনীর স্বীকৃতি পেয়ে ধন্য হয়েছেন। বার্ধক্য-পূর্ব জীবনকে বৃক্ষ, শাখা, পত্র-পল্লবের যুগ বলা যেতে পারে। আর বার্ধক্য হলো ফুল ও ফল লাভের জীবন। তার মানে সারা জীবনের চেষ্টা-তৎপরতার ফলাফল প্রাপ্তির সময় হলো বার্ধক্যের জীবন। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণালব্ধ এই সত্য প্রকাশে নির্দ্বন্দ্ব যে, বৃদ্ধ বয়সেই মানুষ বিশেষ করে শিল্পী-সাহিত্যিক ও লেখকেরা তাঁদের সার্থক দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ প্রকাশ ঘটাতে পারেন। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসন বার্ধক্যকে নিরর্থক জীবনের ঠিক বিপরীতে সফল জীবন বলে উল্লেখ করেছেন। প্রায় অভিন্ন মতামত পাওয়া যায় চার্চিল, পিকাসো এবং রাসেলের মতো দার্শনিকদের কাছ থেকেও। এরা নব্বুই বছর বয়সেও নিজেদের মেধা ও মননকে হেফাজত করেছেন।
অষ্টাদশ শতকের জগদ্বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার তাঁর বহুল আলোচিত গ্রন্থ 'দর্শন সংস্কৃতি' লিখেছেন সত্তর বছর বয়সে। মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন,বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক হিসেবে সবাই একনামে চেনেন তাঁকে। তিনিও তাঁর মহান আবিষ্কারটি করেছিলেন সত্তুর বছর বয়সে। সুতরাং বার্ধক্য বা অবসরকালীন জীবনকে ব্যক্তি জীবনেরই একটা অধ্যায় বলে ধরে নিতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার সঙ্গে মিল রেখে এই জীবনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা না হলে কেবল নিজের জন্যই নয় বরং সমাজ এবং নিজের পারিবারিক জীবনেও বিচিত্র সংকটের জন্ম হতে পারে। দেখা দিতে পারে মানসিক সমস্যাও। অবসরকালীন নতুন জীবনের সূচনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তির মাঝে নেমে আসতে পারে এক ধরনের বিষন্নতা, উত্তেজনা, অসন্তোষের মতো নানাবিধ নেতিবাচকতা। এটা অবসরে যাওয়া ব্যক্তি চাইলেও হতে পারে, না চাইলেও হতে পারে।
অবসর জীবনের বিষন্নতাকে পাশ কাটানোর জন্য সব কিছুর আগে ব্যক্তিকে একটি বিষয়ে ভাবতে হবে। সেইসঙ্গে মেনে নিতে হবে যে, এই জীবনে যাওয়া এমন একটি বিষয় যে এর থেকে নিস্তার পাবার কোনো সুযোগ নেই। বেঁচে থাকলে সবাইকেই এই জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। সুতরাং কোনোভাবেই এই জীবনপর্ব যেন ব্যক্তির মন-মানসিকতার ওপর নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি করতে না পারে-সেদিকে খেয়াল রাখাই যুক্তিযুক্ত। তাই প্রয়োজন হলো সুন্দর ও দূরদর্শী পরিকল্পনা। যেমন ভ্রমণ, পছন্দের বইগুলো পড়া, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পালাক্রমে দেখা-সাক্ষাৎ করা ইথ্যাদি। বন্ধুসঙ্গ পেলে খুবই ভালো কাটতে পারে এই কাল-পর্বটি। আর অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির সময় ভালোভাবে কাটলে পাশে যারা থাকবে তারাও ভালো সময় কাটাতে পারবে। সর্বোপরি ভাবতে হবে, অবসরকালীন জীবন মানে পথের শেষ নয় বরং নতুন একটি জীবন পর্বের শুভ সূচনা। বলা যেতে পারে নতুন জন্ম। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।