সুরা মুজ্জাম্মিলের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা মুজ্জাম্মিলের নবম আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)কে বলা হচ্ছে তিনি যেন পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিপালক তথা একমাত্র উপাস্য মহান আল্লাহকেই অভিভাবক ও সংরক্ষক হিসেবে মেনে নেন।
-এ আয়াতে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা বা তাওয়াক্কুল করার তথা সব কাজ ও ইচ্ছাকে মহান আল্লাহর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ মহান আল্লাহ হচ্ছেন গোটা বিশ্ব-জগত ও অস্তিত্ব জগতের প্রতিপালক। সমগ্র অস্তিত্ব জগতের ওপর রয়েছে মহান আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও অভিভাবকত্ব। তিনিই একমাত্র উপাস্য তথা ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। মানুষের যত ধরনের শক্তি ও ক্ষমতা আছে তা এসেছে মহান আল্লাহর কাছ থেকে। মানুষের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া মানুষের প্রতি তাঁর আমানত মাত্র। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার ক্ষমতাই অস্থায়ী ও নড়বড়ে হওয়ায় তাদের ওপর ভরসা বা নির্ভর করা যায় না। মানুষসহ আল্লাহর কোনো সৃষ্টিই কোনো কিছুর প্রকৃত মালিক নয় এবং তারা কখনও কোনো কিছুর প্রকৃত মালিক হতে পারবে না।
কেবল মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করার বিষয়টি অস্তিত্ব জগতের স্রস্টা হিসেবে মহান আল্লাহকে জানার ও চেনার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেউ যদি এটা বুঝতে পারে যে মহান আল্লাহই হচ্ছেন আসল মালিক এবং আমাদের সব কিছুর অস্তিত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহরই হাতে রয়েছে তাহলে সে কখনও অন্যের দিকে যাবে না ও অন্যের কাছে কিছু চাওয়ারও চেষ্টা করবে না। আমরা যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পুরোপুরি ভরসা করি এবং আমাদের আত্মা ও চেতনাকে মহান আল্লাহর স্মরণে সব সময় করি সুরভিত তাহলে আমাদের ঈমানও সব সময় হবে চির-সতেজ ও প্রাণবন্ত।

সুরা মুজাম্মিলের একটা অংশে বলা হয়েছে যে পুনরুত্থান ও বিচার-দিবসের প্রাক্কালে বস্তুর-জগত ধ্বংস হয়ে যাবে। কুরআনের নানা সুরায় কিয়ামতের দিনে পাহাড়-পর্বতের ধ্বংস হওয়ার নানা পর্যায় সম্পর্কে বক্তব্য দেখা যায়। অথচ পাহাড় হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে সুদৃঢ় অংশ। সুরা মুজাম্মিলের ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, যেদিন পৃথিবী ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে এবং পর্বতগুলো হয়ে যাবে বহমান বালুকাস্তুপ।
সুরা মুজাম্মিলের ১৭ নম্বর আয়াতে কিয়ামতের অন্য একটি বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে: তাই,তোমরা কিভাবে আত্নরক্ষা করবে যদি তোমরা সেদিনকে অস্বীকার কর,যেদিন বালককে করে দেব বৃদ্ধ?-
নানা কষ্ট ও মুসিবতের মধ্য দিয়ে কিয়ামতের দিনটিকে খুব দীর্ঘ বলে মনে হবে। অনেকেই সেদিন বহু ধরনের কষ্ট ও বিপদের শিকার হলেও সেদিন কারোই মৃত্যু ঘটবে না। কষ্টের তীব্রতায় যুব-বয়সীরা বৃদ্ধ হয়ে পড়লেও তাদের মৃত্যু ঘটবে না।
আর এই দীর্ঘ কঠিন দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহ বলছেন, হে মানুষ খোদাভীতি অবলম্বন কর সেই দিনের জন্য যে দিনটিতে ঘটবে ভূমিকম্প কিয়ামত বা পুনরুত্থানের কেবল সূচনা হিসেবে। সেদিনটি তীব্র কষ্ট হবে এ জন্য যে সেদিন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বঞ্চনা ও তীব্র গরমের মোকাবেলায় প্রতিরক্ষার এবং নিরাপত্তার কিছুই থাকবে না। সেই দিনটি হয়ত বাস্তবে খুব বেশি দীর্ঘ নয়। কিন্তু একটানা কষ্ট ও ভোগান্তির কারণে অনেক মানুষের জন্য তা খুবই কঠিন ও দীর্ঘ মনে হবে। সেদিন কেবলই আন্তরিক ঈমান ও সৎকর্ম কাজে আসবে।
সুরা মুজাম্মিলের দীর্ঘতম আয়াতটি হল শেষ আয়াত তথা বিশ নম্বর আয়াত। এ আয়াতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য রয়েছে। যেমন, মহানবীর (সা) পাশাপাশি একদল মুমিনেরও নৈশ ইবাদতে মশগুল থাকার বিষয়। ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থার কারণে সেই বিশেষ সময়ে রাতের বেলায় কুরআন তিলাওয়াত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনে চিন্তাগত, জ্ঞানগত ও নৈতিক নানা বিষয় থাকায় সেসব জ্ঞান অর্জন করা ছিল জরুরি। নৈশ ইবাদত আত্মগঠনের জন্য খুবই কার্যকর এবং তা মুমিনকে ইসলাম প্রচার ও ইসলামের প্রতিরক্ষার জন্য যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলে। অবশ্য রাতের এক তৃতীয়াংশ সময় জেগে থেকে ইবাদত করার হিসাব ঠিক রাখতে গিয়ে অনেকেই কিছু সমস্যার শিকার হন, ফলে তারা পুরো রাত জেগেই ইবাদত করতে থাকেন এবং এর ফলে অনেকেরই পা ফুলে যায়। তাই মহান আল্লাহ তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য বললেন: তিনি জানেন,তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। তাই তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরায়ন হয়েছেন। তাই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ,ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে,কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জেহাদে লিপ্ত হবে। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর।
অবশ্য কুরআন তিলাওয়াত বা আবৃত্তি হতে হবে চিন্তা-ভাবনা ও গভীর মনোযোগসহকারে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ) বলেছেন, ঠিক ততটুকু কুরআন তিলাওয়াত কর যাতে তার মধ্যে আত্মিক বিনম্রতা বা ভয়-বিহ্বলতা, পরিশুদ্ধি, আনন্দ ও আধ্যাত্মিকতা থাকে।
আয়াতের অন্য অংশে আত্মগঠনের একট পরিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে বলা হয়েছে, নামাজ কায়েম কর ও জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ বা কার্জুল হাসানাহ্ দাও তথা আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত কর। আর জেনে রাখ, তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্যে আগে পাঠাবে,তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল,দয়ালু।
আয়াতের শেষাংশে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে এটা বোঝানো হচ্ছে যে আমরা রাত জেগে কিছু ইবাদত করে যেন নিজেদেরকে পরিপূর্ণ মানব বা মুক্তিপ্রাপ্ত মনে না করি। বরং সব সময়ই আল্লাহর দরবারে নিজেকে তুচ্ছ ও হীন ভাবতে হবে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।