জুন ০৮, ২০১৯ ১৭:২৩ Asia/Dhaka

সুরা মুদ্দাস্সির মক্কায় নাজিল-হওয়া একটি সুরা। এর আয়াত-সংখ্যা ৫৬। এটি ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্য হওয়ার পর নাজিল-হওয়া প্রথম সুরা। যে কোনো মাক্কি সুরার মতই সুরা মুদাসসিরেও রয়েছে কিয়ামত বা বিচার দিবস ও পরকাল, সৃষ্টির উৎস, শিরকের বিরোধিতা, খোদাদ্রোহী ও অবিশ্বাসীদের প্রতি খোদায়ি শাস্তির হুমকি সম্পর্কিত আলোচনা।

মহানবীর (সা) দাওয়াতের মূল নীতির ব্যাখ্যা ও  এই দাওয়াতের প্রধান দিকগুলোর বর্ণনা, বলদর্পি বা অহংকারী মানুষের নানা বৈশিষ্ট্য, মানুষের কৃতকর্মের সঙ্গে তার পরিণতির সম্পর্ক, বেহেশতিদের বৈশিষ্ট্য এবং দোযখের পাহারায় ও খোদায়ি শাস্তি বাস্তবায়নে নিযুব্ক ফেরেশতাকুল নিয়েও বক্তব্য এসেছে সুরা মুদাস্‌সিরে।

 

সুরা মুদাস্‌সিরে উল্লেখিত 'মুদ্দাস্সির ' শব্দটির অর্থ হচ্ছে নিজেকে গুটিয়ে রাখা কিংবা ঘরকুনো করে রাখা। এ সুরার প্রথম আয়াতে বিশ্বনবী (সা)কে বলা হচ্ছে যে তিনি যেন তার বিরোধীদের অপমানজনক কথা ও নির্দয় আচার-আচরণে দুঃখ-ভারাক্রান্ত না হন এবং নিজেকে গুটিয়ে না রাখেন। বরং তিনি যেন গুটানো অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে দৃঢ়-চিত্তে  মানুষকে সুপথ দেখানোর ও সতর্ক করার তৎপরতা চালান।

 

সুরা মুদাস্‌সিরের প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনায় তাওহীদ তথা একত্ববাদের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং মহান প্রতিপালককে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে ভাবতে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ হচ্ছেন মহানবীসহ সবারই মালিক ও প্রতিপালক। তাই মিথ্যা প্রভুদের নাকচ করতে হবে এবং শিরক বা অংশিবাদিতা ও মূর্তি পূজাকে ধ্বংস করতে হবে। অন্য কথায় এক আল্লাহর বাস্তবতাকে চিন্তা ও বিশ্বাস, কাজকর্ম ও কথায় সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরা উচিত। এটা জানা উচিত যে সবচেয়ে সুন্দর গুণ ও নামগুলো হচ্ছে মহান আল্লাহর। তিনি যে কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে মুক্ত।  এটাও মনে রাখা দরকার যে মহান আল্লাহ হচ্ছেন এমন এক সত্ত্বা যাকে কোনো বর্ণনার মাধ্যমে পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না।  

 

এরপর পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র থাকতে মহানবীকে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে: আপনার পোশাককে পবিত্র রাখুন। পোশাক বলতে নানা তৎপরতা ও কাজকর্মকে বোঝানো হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ মানুষের আচার-আচরণ ও তৎপরতা তার পোশাকের সমতুল্য। আবার  কেউ কেউ বলেন, পোশাক বলতে এখানে অন্তর ও আত্মাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আত্মাকে সব ধরনের কলুষতা থেকে মুক্ত করা বাহ্যিক পোশাক-আশাক মুক্ত করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন, এখানে বাহ্যিক পোশাক-আশাকের পবিত্রতার কথাই বলা হয়েছে যা একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।

সুরা মুদাস্‌সিরের সপ্তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: হে নবী! আপনার পালনকর্তার সন্তুষ্টির জন্য সবর করুন।

অর্থাৎ মহামহিম আল্লাহ বলছেন,হে নবী! মুশরিকরা এবং অজ্ঞ ও মূর্খ শত্রুরা আপনাকে জ্বালাতন করলেও আপনি দমে না গিয়ে ধৈর্য ধরুন। এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে মহানবীর (সা) ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল খুবই ভারী। আর খোদায়ি সাহায্য ছাড়া এই বিশাল ও মহান দায়িত্ব পালন সম্ভব হত না। অন্যদিকে এ দায়িত্বের গুরুভার এটাও স্পষ্ট করছে যে মহানবীর মত পরিপূর্ণ আদর্শ ব্যক্তিও সব অবস্থায় মহান আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী। শুধু তাই নয়, দিনকে দিন আল্লাহর ওপর মুখাপেক্ষিতা বাড়তেই থাকে এবং ব্যাপারটা এমন যে মহান আল্লাহর মুকাবেলায় তিনি নিজের কোনো কিছুই রয়েছে বলেই মনে করতেন না। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বা দৃঢ়তার কথা এ জন্যই উঠেছে যে প্রচার ও সুপথ দেখানোর কাজে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুঁজি। ধৈর্য ও সহনশীলতা সব কর্মসূচিকে সফল করার মূল ভিত্তি। তাই পবিত্র কুরআনে বহুবার ধৈর্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য এসেছে। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ধৈর্য ও দৃঢ়তার গুরুত্ব হচ্ছে মানব দেহের অন্যান্য অংশের তুলনায় মাথার গুরুত্বের সমতুল্য।

 

নবী-রাসুল এবং আল্লাহর ওলিদের চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধৈর্য। তাঁদের ওপর বিপদ-আপদ যতই কঠিন হত ততই তারা বেশি ধৈর্যশীল হতেন। তারা এসব বিপদাপদকে বরং উপভোগ করতেন! বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, মহান আল্লাহ জানিয়েছেন, যখন আমি আমার কোনো বান্দার জীবন বা সম্পদ কিংবা তার সন্তানের ওপর বিপদ দেই তখন সে যদি দর্শনীয় ধৈর্য ধরে তার মোকাবেলা করে তাহলে কিয়ামতের দিন তার কৃতকর্মের জন্য বিচারের দাঁড়ি-পাল্লা বা মানদণ্ড  বসাতে কিংবা তার কৃতকর্মের খাতা খুলে দেখতেও আমার লজ্জা হবে।

 

সুরা মুদাস্‌সিরের ১১ থেকে ৩৬ নম্বর আয়াত ওয়ালীদ বিন মুগায়রা সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। সূরা মুমিন নাযিল হলে মহানবী (সা.) কা’বা প্রাঙ্গণে তা সাহাবীদের মধ্যে পাঠ করেন। মুগায়রাও সেখানে তা শুনেছিল। এরপর সে তার দলের কাছে বলে, ‘আল্লাহর কসম,আমি মুহাম্মাদের মুখে এমন বাণী শুনেছি যা না মানুষের,আর না জিনের। তার ভবিষ্যৎ খুবই ভাল হবে এবং সে কখনও হবে না পরাভূত।’ ফলে কাফিররা ভাবল,মুগায়রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে! আবু জাহল তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,সে তার বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করেছে কি না এবং তাদের দলের মনোভাবের কথাও ব্যক্ত করল। এ অবস্থায় মুগায়রা আবু জাহলকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দলের কাছে এসে বলতে লাগল,‘তোমরা কি মুহাম্মাদকে উন্মাদ মনে কর?’ তারা বলল, ‘না।’ সে বলল,‘তাকে কি তোমরা গণক মনে কর?’ তারা বলল, ‘না।’ সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,‘তাকে কি তোমরা মিথ্যাবাদী মনে কর?’ তারা বলল,‘আমরা তো তাকে সত্যবাদী উপাধি দিয়েছি।’ সে বলল,‘তবে কি তোমরা তাকে কবি মনে কর?’ তারা সব চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়ল। অবশেষে মুগায়রা নিজেই বলল,‘আসলে সে একজন জাদুকর,এছাড়া কিছুই না। এজন্যই সে পিতা-পুত্রের মধ্যে,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে থাকে।’ তার এ কথা শুনে কাফিররা সন্তুষ্ট হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/  ০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।