জুলাই ২১, ২০১৯ ২০:২০ Asia/Dhaka

বাংলাদেশে ত্রিধারার রাজনীতি আদৌ চলবে কিনা সেটা নির্ভর করছে দেশের বর্তমান রাজনীতির ওপর। বাংলাদেশের রাজনীতি কোনদিকে যাবে সেটি রাজনৈতিক পণ্ডিতরাও বলতে পারছেন না। কারণ দেশের রাজনীতি আসলে গৃহবন্দি বলতে পারেন। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার মতিউর রহমান চৌধুরী।

তিনি বলেন, এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে তার বিরোধীতা করায় আমি জেল খেটেছি। আমার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে লেখায় আমার পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখনও আমার বিরুদ্ধে মামলা চলছে।

এরশাদের জানাযা

তিনি  বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদকে রহস্যপুরুষ বলে অভিহিত করেছেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রহস্যে রেখে গেছেন নিজেকে। তিনি ছিলেন আনপ্রিডেক্টেবল। তিনি নিন্দিত এবং নন্দিত দুটোই। 

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান:  জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হোসেইন মুহম্মাদ এরশাদের মৃত্যু হয়েছে তবে তাকে নিয়ে নানারকম আলোচনা চলছে। সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৮২ সালে তার ক্ষমতা দখল এবং স্বৈরাচার তকমাটি প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে অনেকে বলছেন একজন মৃত মানুষ নিয়ে এমন আলোচনা ঠিক নয়। আপনার মন্তব্য কী?

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও দলটির প্রতিষ্ঠাতা হোসেইন মুহম্মাদ এরশাদকে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্যরকম। কারণ এরশাদ সাহেবের ৯ বছরের শাসনামলের পুরোটাকেই আমি বিরোধীতা করেছি। আমি জেলে গেছি। আমার লেখার জন্য পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে আমার গাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিল এরশাদ সাহেবের লোকজন। ফলে আমার সঙ্গে এরশাদ সাহেবের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত তিক্ত। অবশ্য একসময় তাঁর সঙ্গে আবার খানিকটা ভালো সম্পর্ক হয়েছিল।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম এইচ এম এরশাদ

তবে পৃথিবীতে একমাত্র সেনাশাসক এরশাদ যিনি ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। এরকম ক্ষেত্রে দেখা গেছে হয়তো জেলে যেতে হয় অথবা ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়। এরশাদ সাহেব জেলে গিয়েছিলেন কিন্তু জেলে থাকা অবস্থায় ৫ টি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরশাদ সাহেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিচিত্র একটি চরিত্র। তিনি দেশের দুই ধারার রাজনীতির মাঝখানে নতুন একটি ধারার রাজনীতি দিয়েছিলেন, একটি দেয়াল তৈরি করেছিলেন।

সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছিলেন। তার শাসনকাল এবং অন্যদের শাসনামল বা বর্তমান শাসনমালের সঙ্গে মানুষ তুলনা করে থাকে। তিনি ক্ষমতার দৃশ্যপটে বিভিন্ন সময় আবির্ভূত হয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের কথা উল্লেখ্য। এসময় আমরা ভিন্নভাবে তাঁকে দেখেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে তিনি উধাও হয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন-কি ব্যাপার- কোনো খোঁজ খবর নেই এরশাদ সাহেবের। সে সময়টাও জাতীয় পার্টির একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। তিনি রাজনীতিতে সব সময় একটা ব্যালেন্স করার চেষ্টা করেছেন। সবাই যখন তাকে আক্রমণ করেছে তিনি তার কড়া কোনো জবাব দেন নি। তারমধ্যে একটা সহনশীন মনোভাব ছিল এটাকে স্বীকার করতেই হবে। যদিও আমি সবসময় তার বিরোধী ছিলাম।

আমি 'দুর্নীতি পরায়নদের উল্লাসের নৃত্য' লিখেছিলাম। আর সেজন্য এরশাদ সাহেব আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তবে এরশাদ সাহেব বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটা মাত্রাও যোগ করেছিলেন পরবর্তীকালে। জেলে ঢুকেও বারবার যে ৫ টি আসনে জয়লাভ করা যায় সেটি তিনি প্রমাণ করেছেন। কারণটি আগেও বলেছি তার সময়কাল এবং আগে- পরের শাসনকাল মিলিয়ে মানুষ এরশাদকে ভোট দিয়েছেন।

রেডিও তেহরান: বাংলাদেশের রাজনীতিতে জীবিত নেতার চেয়ে মৃত নেতার প্রভাব কম নয়- এটা আমরা মরহুম জিয়াউর রহমান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষেত্রে দেখেছি। এরশাদের বেলায় তেমনটি ঘটবে বলে মনে হয়?

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, এটি নির্ভর করবে এরশাদের জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে তার ওপর। আমরা যখন কথা বলছি তখন জানলাম জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছেন এরশাদ সাহেবের ছোটো ভাই জি এম কাদের। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় পার্টির জন্য এরশাদ যে রাজনীতি দিয়ে গেছেন জি এম কাদের সেটি দিতে পারবেন কি না তার ওপর! দলটি এক থাকবে কি না সেটিও একটি প্রশ্ন! নানাকারণে আমার মধ্যে সংশয় রয়েছে যে জাতীয় পার্টি ভেঙ্গে যাবে। আর এর মধ্যে নানারকম উপাদান রয়েছে। তবে জাতীয় পার্টি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে আপনি যে প্রশ্নটি করলেন মৃত রাজনীতিবিদরা যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন একইরকম এরশাদ সাহেবের দলও করবে। কিন্তু আমার কাছে কেন জানি মনে হয় জাতীয় পার্টি যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকে সেক্ষেত্রে সেই আবেদনটি কমে যাবে। 

ত্রিধারার রাজনীতি আদৌ চলবে কিনা সেটা নির্ভর করছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির ওপর। বাংলাদেশের রাজনীতি কোনদিকে যাবে সেটি রাজনৈতিক পণ্ডিতরাও বলতে পারছেন না। কারণ দেশের রাজনীতি আসলে গৃহবন্দি বলতে পারেন।

রেডিও তেহরান: দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ অনেকটা হাসির পাত্র হয়েছিলেন। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, কারণ খুবই সহজ। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা ছিল।সেসব মামলা এখনও প্রত্যাহার হয় নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মামলা মাথায় নিয়েই তিনি মারা গেছেন। ক্যাসেট কেলেঙ্কারির একটা মামলায় আমার সাথে  এরশাদ সাহেবের জেল হয় ৬ মাস এবং আমার ১ মাস। সেই মামলা এখনও শেষ হয় নি। ১৪ বছর ধরে সেই মামলা এখনও চলছে। আপিল বিভাগে সেই মামলা এখনও ঘুরছে। কোনো ফয়াসালা হয় নি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদ

সে যাইহোক জেনারেল এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলার মধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলা একটি অন্যতম মামলা। যদিও তিনি মহাজোটে ছিলেন তারপরও তিনি এই মামলাটা প্রত্যাহার করতে পারেন নি। অনেকের অনেক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে কিন্তু এরশাদ সাহেবের অনেক মামলা এখনও চলছে। এসব কারণে এরশাদ সব সময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকতেন। কখন কোন মামলা দিয়ে তাকে জেলে নেয়া হবে এই ভয় ছিলো তার মধ্যে। তাছাড়া তার ওপর বিভিন্ন মহল থেকে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ ছিল। আর এসব কারণে তিনি হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন আবার  উদয় হতেন। নির্বাচনের আগে হাঠৎ করে তিনি উধাও হয়ে গেলেন। ফিরে এসে বললেন আমি তো নির্বাচনে দাঁড়াতে চাই নি। এরকম পরিস্থিতি অনেকবার দেখা গেছে। অনেকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা গেছে। তার সঙ্গে সাংবাদিকরাও দেখা করতে পারতেন না।

বিচিত্র মানুষ ছিলেন এরশাদ। তার জীবনের শেষ কথাটা বলে যেতে পারেন নি। গত রমজানে উনি ইফতারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। ওনার সেই ইফতারির দাওয়াতে আমি গিয়েছিলাম। ওনার সাথে কথা হয়েছিল। কিন্তু ওনার সব কথা আমি বুঝি নি। কারণ ওনার কথা তখন জড়ানো ছিল। ভালোভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। তার অনেক কথাই জানা যায় না। তিনি একটা বই লিখেছেন কিন্তু বইয়েও তিনি সব কথা লিখতে পারেন নি। তার জীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত  বরাবরই একটা রহস্য পুরুষ ছিলেন। মারা যাওয়ার সময়ও রহস্য রেখে গেছেন।

রেডিও তেহরান: এরশাদের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলা ছিল কিন্তু বিচার শেষ করা যায় নি। একে কী রাষ্ট্রের ব্যর্থতা বলে মনে করেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী: সমাধান হয়ত হতো কিন্তু বাংলাদেশে তো অনেক কিছু বলা যায় না। হয়তো তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো সমাধান না হওয়াটা কৌশলের একটি অংশ ছিল। হয়ত ইচ্ছে করেই তার বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হয় নি। মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তখন এরশাদ সাহেব মুক্ত মানুষ হয়ে যাবেন। এমন একটা ভয় বা বলাবলি ছিল যে যদি এরশাদ সাহেবের মামলা প্রত্যাহার হয়ে যায় তখন তাকে আর ধরে রাখা যাবে না। কারণ তিনি আনপ্রিডেক্টেবল মানুষ। কখন কি সিদ্ধান্ত নেন তা বলা মুশকিল ছিল। তিনি সকালে একরকম সিদ্ধান্ত নেন আবার বিকেল তা পরিবর্তন করে ফেলেন। এসব কারণে হয়তো তার মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয় নি।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদ

যদিও দেশের রাজনীতিতে তার ভোটের পার্সেন্টেজ খুব একটা বেশি নেই তারপরও তিনি মোটামুটিভাবে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে গেছেন। ফলে তাকে অনেকের প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্ত মানুষ ছিলেন না এবং মামলা মোকদ্দমা কোনোটারই নিষ্পত্তি করা হয় নি।

রেডিও তেহরান: এরশাদের রাজনৈতিক উত্থান-পতনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, ১৯৮২ সালে যখন তিনি ক্ষমতায় আসেন তখন দেশের রাজনীতিতে একটা শূন্যতা ছিল। ছাত্তার সাহেবের সরকারকে মোটামুটি ব্যর্থ বলা চলে। অনেকে বলেন যে এর পেছনে এরশাদ সাহেবের হাত ছিল। তো যাইহোক ওই সময়ে তিনি রাজনীতিতে এসে একটি তৃতীয় ধারার রাজনীতি চালু করতে চেয়েছিলেন এবং মোটামুটি সফল হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নির্বাচন দিয়েছেন। বিরোধীরা বিরোধীতা করেছে। ৯০'র আন্দোলন হয়েছে তার বিরুদ্ধে এসব ইতিহাস মোটামুটি সবার জানা।

তবে এরশাদ সাহেবের কিছু গুণও ছিল। গুণটা ছিল- কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি ফ্লেক্সিবেল ছিলেন রিজিড ছিলেন না। আমরা অন্যটাও দেখেছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাউকে কাউকে এমনটি দেখেছি যে, একটি সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্তেই অনড় থাকব। তবে এরশাদ সাহেব তেমনটি ছিলেন না। যে কারণে এখনও মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। হয়তো তার জনপ্রিয়তা এলাকাভিত্তিক হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি রংপুর কেন্দ্রীক হয়ে গেছে কিন্তু তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজেকে জাহির করতে চান নি। তিনি এটা দেখাতে চান নি যে আমার হাতে ক্ষমতা আছে অতএব আমি এটা করবই এমনটি দেখা যায় নি। তবে হ্যাঁ একথাও সত্যি যে তার শাসনামলে বা ক্ষমতা দখলের সময় যে অনেক কিছু বাড়াবাড়ি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও যদি আমরা ইতিহাসের নিরীখে মিলাই তাহলে দেখব যে না তিনি অনেক সহনশীল ছিলেন। আমি-আমার কথাই বলতে পারি। একসময় আমি তার চরম বিরোধীতা করেছি। পরে আমি আমার একটা লেখাতে লিখেছি ক্ষমা করবেন স্যার। আমি যা চেয়েছিলাম তা পাই নি। এরশাদ সাহেব মারা যাওয়ার ৫/৬ মাস আগে আমি এ লেখাটি লিখেছিলাম। এটি আমার নিজের অভিজ্ঞতা। 

তবে সবশেষে বলব, এরশাদ সাহেব এদেশের মানুষের কাছে আলোচিত থাকবেন আবার সমালোচিত হবেন। তিনি নিন্দিত হবেন আবার নন্দিত থাকবেন। তবে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আলোচিত নাম এতে কোনো সন্দেহ নেই।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২১