ইরানি পণ্য সামগ্রী: ইরানের চিংড়ি বিশ্বের সুস্থ ও উন্নতমানের
আপনারা জানেন যে, ইরানের জলে-স্থলে, ক্ষেত-খামারে, বাগ-বাগিচায়, কল-কারখানায় উৎপাদিত হয় বিচিত্র সামগ্রী। এর পাশাপাশি খনি থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন সামগ্রী এবং ইরানি নরনারীদের মেধা ও মনন খাটিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিল্পপণ্য।
গত আসরে আমরা ইরানের একেবারে ভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। ইরান একটি বিশাল বিস্তৃত দেশ। মরু-পর্বত-সমুদ্রময় এই দেশটির দুই হাজার সাত শ কিলোমিটারের মতো শুধু পানিসীমাই রয়েছে। সুতরাং জলীয় সম্পদ বিশেষ করে মৎস্য জাতীয় খাদ্যপণ্যে দেশটি যে কতোটা সমৃদ্ধ তা বলাই বাহুল্য।
বিশেষ করে ইরানের জলীয় সম্পদ চিংড়ি নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। বলেছি যে অনিয়ম মাছ শিকারের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিশেষত চিংড়ি জাতীয় মাছের ওপর। এই চিংড়ি প্রজাতির মাছ নোনা জলে যেমন হয় তেমনি মিষ্টি পানিতেও হয়। শ্রিম্প বা প্রন বলা হয় ইংরেজিতে। এই মাছ ক্রান্তীয় থেকে আর্কটিক অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। অর্থনৈতিক দিক থেকে এই মাছের উচ্চ মূল্য রয়েছে। কত প্রকারের চিংড়ি আছে, কত রঙ-বেরঙের চিংড়ি, বিচিত্র রঙের কারণ, চিংড়ির বসবাস ও জীবনচক্র ইত্যাদি নিয়েও খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
ইরান বেশ বিস্তীর্ণ একটি দেশ। ইরানের দক্ষিণে এবং উত্তরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কেবল পানিসীমাই রয়েছে দুই হাজার সাত শ কিলোমিটার। বিশেষ করে পারস্য উপসাগর এবং ওমান সাগরের কথা না বললেই নয়। এই দুটি কৌশলগত সমুদ্র মৎস্য সম্পদের মতো খোদায়ি নিয়ামতে ব্যাপক মাত্রায় সমৃদ্ধ। কৌশলগত এই এলাকাটি ইরানের পানিসীমার একটি। গুয়াতের অন্তরীপ বা সন্ধিস্থল থেকে শুরু হয়ে আরভান্দ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এই সমুদ্রসীমা। এই সমুদ্রের পানিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি মাছ। এ পর্যন্ত পারস্য উপসাগর এবং ওমান সাগরের নীল পানিতে অন্তত দশ প্রজাতির চিংড়ি মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিংড়ি হলো লবস্টার বা গলদা চিংড়ি। চিংড়ির রাজা বলা হয় এই লবস্টারকে। চিংড়ি মাছ সাধারণত হালকা পাতলা ওজনের হয়ে থাকে। কিন্তু একটি লবস্টার বা গলদা চিংড়ির ওজন এক কিলোগ্রামও হয়।

লবস্টার প্রজাতির চিংড়ি সাধারণত ওমান সাগরের পাথুরে উপকূলীয় এলাকাতেই বেশি শিকার করা হয়।এর বাইরেও আরও বহু প্রকারের চিংড়ি পারস্য উপসাগরে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: গোলাপি চিংড়ি, ভারতীয় চিংড়ি, কলাকৃতি চিংড়ি, সাদা এবং ছুরির মতো চিংড়ি ইত্যাদি। পেশাগতভাবে জেলে যারা তারা ট্রলার নিয়ে পারস্য উপসাগরে গিয়ে যে চিংড়ি শিকার করে তার শতকরা আশি ভাগই হলো গোলাপি চিংড়ি। এর বাইরে ওমান সাগর এবং পারস্য উপসাগরে যেসব চিংড়ি শিকার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে কলাকৃতি চিংড়ি এবং ভারতীয় প্রজাতির চিংড়ি। কলার মতো চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ জাতীয় চিংড়িগুলো হরমুজগান প্রদেশের নীলজলেই বেশি শিকার করে জেলেরা। ভারতীয় সাদা চিংড়ি এবং কালো বাঘ প্রজাতির চিংড়ি একটু বড়সড়ো হলেও এইসব প্রজাতির চিংড়ির বসবাসের উপযোগি স্থানের সীমাবদ্ধতা থাকায় অর্থনৈতকি বা বাণিজ্যিক দিক থেকে এগুলো খুব বেশি লাভজনক নয়।
সামুদ্রিক ও জলজ সম্পদ বিশেষ করে মৎস্য সম্পদের পরিমাণ সীমিত হয়ে পড়ার কারণে প্রয়োজনীয় প্রোটিন চাহিদা নিশ্চিত করতে মৎস্য চাষ করা অন্যতম বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিংড়ি মাছ চাষের ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে গেল শতাব্দির ষাটের দশকে। জাপান প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি মাছের চাষ শুরু করে। ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। খুজিস্তান, বুশেহর, হরমুজগান এবং সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে এখন চিংড়ির চাষ ব্যাপক মাত্রায় হচ্ছে। ইরান দেশটি আবহাওয়ার কারণে কৃষিকাজসহ চিংড়ি এবং অন্যান্য মাছ চাষের জন্য বেশ উপযোগী। প্রায় আঠারো শ কিলোমিটারের মতো উপকূল রয়েছে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় পারস্য উপসাগর এবং ওমান সাগরের তীরে। এই পুরো এলাকাটাই মাছ চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তবে এই উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ চাষের সূচনার অন্তত বিশ বছর আগে থেকে ইরানে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের প্রচলন শুরু হয়।
হরমুজগান প্রদেশে সবার আগে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের কাজ শুরু হয়। বর্তমানেও সেখানে চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ চাষের বিশাল বিশাল ঘের রয়েছে। চিংড়ির মধ্যে গ্রিন টাইগার চিংড়িই বেশি চাষ হচ্ছে এখানে,যার অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি।ইরানে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে চিংড়ির ডিম থেকে রেণু ফুটিয়ে পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির চাষ করা হয়। ডিম কেনার জন্য বিভিন্ন কেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে কিনে এনে বিশেষভাবে তৈরি পুকুরে ছাড়া হয়। প্রতি হেক্টরে প্রায় দশ থেকে বিশ হাজার রেণু জন্মানো হয়। চিংড়ির খাবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুকনো। চিংড়ি চাষে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় এদের খাবারে। চিংড়ি চাষে যত খরচ হয় তার প্রায় অর্ধেকই খরচ হয়ে যায় চিংড়ির খাবারে। চিংড়ির রেণুর গুরুত্বপূর্ণ খাবার হচ্ছে আর্টেমিয়া। এটি এক ধরণের জীবন্ত প্রাণী। ইরানের উরুমিয়া হ্রদের নোনাজলে এগুলো পাওয়া যায়। ইরানি বিশেষজ্ঞরা আর্টেমিয়া শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বাইরে থেকে আর চিংড়ির খাবার আনার প্রয়োজন পড়ে না।
ইরানের চিংড়ি বিশ্বের সুস্থ ও উন্নতমানের চিংড়ির অন্যতম। কোয়ালিটি বা গুণগত মান রক্ষার কারণে ইরানের চিংড়ির চাহিদা বিশ্বব্যাপী। চাহিদা বেশি হবার কারণে ফ্রান্স এবং স্পেনের মতো দেশগুলো অগ্রিম চিংড়ির অর্ডার দিয়ে রাখে। ইরানের বেশিরভাগ চিংড়ি পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানে রপ্তানি হয়। বুশেহরে এখন গড়ে তোলা হয়েছে চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র। ইকোলজিক্যাল বৈচিত্র্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চিংড়ি উৎপাদনে উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ইরানি মৎস্য গবেষকরা। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।