মহররমে শহীদ-সম্রাটের মহাবিপ্লব (পর্ব-৩)
কীভাবে নবীর (সা.) উম্মতই নবীর (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো (!)? -এ জিজ্ঞাসা সব যুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
আর এ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা.) উম্মত যারা রাসূল এবং তাঁর বংশকে ভালবাসে বলে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছিল। তাও আবার রাসূলের (সা.) সেইসব শত্রুর পতাকাতলে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের (সা.) সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে কি-না রাসূলুল্লাহ (সা.)মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন!
মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমতি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের উক্তিটি সুপ্রযোজ্য । তিনি বলেছিলেন-
“ তারা মুসলমান হয়নি, ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র।”
আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর ধরে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে যুদ্ধ করেছে। শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করে। মোয়াবিয়াও তার বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের চরম শত্রুতায় নামে। অথচ রাসূলুল্লাহর (সা.) ওফাতের মাত্র দশ বছর পরে সেই মোয়াবিয়াই সিরিয়ার গভর্নর হয়ে বসে। আরও বিশ বছর পরে ইসলামের এই শত্রু হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা! এখানেই শেষ নয়, রাসূলের (সা.) মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াজিদ। আর এই ইয়াজিদ নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধ-শতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো। ঐ সব মুসলমানরা যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিল তা নয়, বরং ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতি তাদের ভক্তির অভাব ছিল তারও কোনো প্রমাণ মেলে না। বরং তারা নিশ্চিতভাবে ইয়াজিদের ওপর ইমাম হোসাইনের (আ.) সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় বিশ্বাস করতো। তাহলে কিভাবে মুসলিম শাসন ক্ষমতা ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়লো? যে মুসলমানরা ইমাম হোসাইনের (আ.) রক্তের মূল্য ভালোভাবেই জানত তারা কিভাবে ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যা করলো?

আসলে উমাইয়া ব্যক্তিত্ব ওসমানের খেলাফতের অপব্যবহার করে উমাইয়ারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে ব্যক্তিগত রাজত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়। স্বয়ং মারওয়ানই এর জ্বলন্ত উদাহরণ। অবশ্য দ্বিতীয় খলিফার শাসনামলেই মোয়াবিয়াকে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমে ইসলামী শাসনযন্ত্রে উমাইয়াদের উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে অন্য সব গভর্নরের পদে রদবদল করা হলেও মোয়াবিয়াকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এটাই ছিল মুসলিম শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে উমাইয়াদের হীন বাসনা চরিতার্থকরণের পথে প্রথম অনুকূল ইঙ্গিত।
উমাইয়ারা তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত মোয়াবিয়া তার সে লালসা পূরণের মোক্ষম সুযোগ পায়। সে ওসমানের রক্তভেজা জামা সবার সামনে মেলে ধরে বলে বেড়ায়,‘যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী (আ.) খলীফা হয়েছেন, তাছাড়া ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন-তাই ওসমান হত্যার জন্য মূলতঃ আলীই (আ.) দায়ী।’ এই বলে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। কারণ, তার কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই চোখের পানি ঝরায় ও শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে মজলুম খলীফার রক্তের প্রতিশোধ নিতে যেই কথা-সেই কাজ- এইরুপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা মোয়াবিয়াকে আশ্বাস দেয়ঃ আমরা প্রস্তুত আছি, তুমি যা বলবে তাই আমরা পালন করতে রাজী আছি। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে।
ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলন ও বিদ্রোহ নিয়েও সবার মধ্যে স্পষ্ট আর স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা নির্বিশেষে সবাই কুফার লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার ইস্যু টেনে ইমাম হোসাইনকে (আ.) বিরত রাখতে চেষ্টা করছিল। তারা যে ইমাম হোসাইনের (আ.) জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এ চেষ্টা চালিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইমাম হোসাইনও (আ.) তাদের চিন্তাধারাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি। অথচ মক্কা,কারবালা এবং কুফার পথে তার বিভিন্ন ভাষ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইমাম হোসাইনের (আ.)ও একটা স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ছিল যা অনেক ব্যাপক ও দূরদর্শী। তাঁর হিতাকাঙ্খীদের ভাবনা কেবল নিজের এবং পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অথচ, ইমাম হোসাইনের (সা.) চিন্তা ছিল দীন,ঈমান ও আকীদার নিরাপত্তাকে নিয়ে। তাই, মারওয়ানের এক নসিহতের জবাবে ইমাম হোসাইন (সা.) বলেনঃ ‘‘ ইয়াজিদের মতো কেউ যদি উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের বিদায় ।’’
মোয়াবিয়া ও ইয়াজিদের ইসলামী শাসন ক্ষমতা লাভ এবং ইসলামে অবিচল মুসলমানদের নিয়ে যথাক্রমে হযরত আলী (আ.) এবং ইমাম হোসাইনের (আ.) বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন ছিল ইসলামের ঊষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলীর অন্যতম। এখানে দুটি বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার। প্রথমতঃ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ইসলাম ও কুরআনের সাথে উমাইয়া বংশের তীব্র সংঘাত এবং দ্বিতীয়তঃ ইসলামী শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তাদের সফলতা। ইসলামের সাথে উমাইয়াদের এহেন শত্রুতাসুলভ আচরণের কারণ হল যে,একাদিক্রমে তিন বংশ ধরে বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার মধ্যে গোষ্ঠীগত কোন্দল চলে আসছিল। এরপর যখন বনি হাশিম ইসলাম ও কুরআনের ধারক ও বাহক হবার গৌরব লাভ করে তখন বনি উমাইয়ারা ঈর্ষায় পুড়ে মরতে থাকে। তাই তারা বনি হাশিমকে সহ্য করতে পারেনি, সাথে সাথে ইসলাম ও কুরআনকেও না সইতে পারেনি।
ইসলামের সঙ্গে উমাইয়াদের শত্রুতার দ্বিতীয় কারণ হলঃ তৎকালীন কোরাইশ গোত্রের কাফের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে উমাইয়াদের পার্থিব জীবনধারার সাথে ইসলামী বিধানের অসামঞ্জস্য ও বৈপরীত্য। ইসলামী নীতিমালায় তাদের প্রভুত্বমূলক প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়। তাদের ভাব ও মন-মানস ছিল সুবিধাবাদী ও বস্তুবাদী। উমাইয়াদের যথেষ্ট বুদ্ধি থাকলেও তাদের ঐ বস্তুবাদী মানসিকতার কারণে খোদায়ী বিধান থেকে তারা উপকৃত হতে পারেনি। কারণ ঐশী শিক্ষাকে সে-ই অবনত মস্তকে গ্রহণ করতে পারে যার মধ্যে মর্যাদাবোধ, উন্নত আত্মা এবং মহত্বের আনাগোনা রয়েছে এবং যার মধ্যে সচেতনতা ও সত্যান্বেষী মনোবৃত্তি নিহিত আছে। অথচ উমাইয়ারা অতিশয় দুনিয়া চর্চা করতে করতে এসব গুণগুলোর সব ক’ টি হারিয়ে বসেছিল। তাই তারা ইসলামের সাথে শত্রুতায় নেমে পড়ে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/০৩