ঐশী দিশারী (পর্ব ৫২): ইমাম মুসা কাজেম (আ.)'র সাংস্কৃতিক বিপ্লব
আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে ইমাম মুসা কাজেম (আ.) সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতি বেশি মনোনিবেশ করেন। পিতার রেখে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আলেম তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
চরম ভীতিকর পরিবেশে মানসুর আব্বাসির ১০ বছরের শাসনকাল অতিক্রম করেন ইমাম মুসা কাজেম (আ.)। ১৫৮ হিজরিতে মানসুর ভবলীলা সাঙ্গ করেন এবং রাজতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে তার পুত্র মেহদি আব্বাসি সিংহাসনে আরোহন করেন। মেহদি ক্ষমতা গ্রহণ করে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে পিতা মানসুরের শাসনামলে আটক বেশিরভাগ রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন ইমাম মুসা কাজেমের অনুসারী শিয়া।
মেহদি আব্বাসি শিয়াদের মুক্তি দিলেও ইমামের তৎপরতা নজরদারি করার জন্য গোয়েন্দা বাহিনীকে লেলিয়ে দেন। তিনি জনগণের মাঝে ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেন। কবিদেরকে বাইতুল মাল থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দান করে ইমামের বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করান। অনর্থক ও ইসলাম বিরোধী কাজে সরকারি অর্থ অপচয়ে তার জুড়ি ছিল না। নিজের ছেলে হারুনের বিয়েতে পাঁচ কোটি দেরহাম খরচ করেন মেহদি আব্বাসি। এ ধরনের অর্থ অপচয় ও লাগামহীন জীবনযাপনের কারণে আব্বাসীয় শাসকের অর্থে রচিত ইমাম বিরোধী কবিতাগুলোর স্বরূপ জনগণের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
ফলে সপ্তম ইমাম (আ.)’র জনপ্রিয়তা উল্টো বাড়তে থাকে। দলে দলে লোক এসে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেদের জ্ঞান পিপাসা মেটায়। ফলে ইমামের অনুসারী বা শিয়াদের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। মেহদি আব্বাসির পক্ষে এই ঘটনা মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি ইমাম মুসা কাজেম (আ.)কে মদীনা থেকে বন্দি করে বাগদাদের কারাগারে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসে বেশিদিন ফূর্তি করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৬৯ হিজরিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার ছেলে হাদি আব্বাসি রাজসিংহাসনে বসেন। হাদি ক্ষমতা গ্রহণ করে ইমাম ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি অনুসরণ করেন। তাঁর নির্দেশেই ‘ফাখ’ গণহত্যা সংঘটিত হয়।
ইমাম হাসান (আ.)’র অন্যতম বংশধর হোসেইন বিন আলীর নেতৃত্বে শিয়ারা আব্বাসি শাসকের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিলেন তার নাম ‘ফাখ’ আন্দোলন। ওই আন্দোলনের জের ধরে মক্কার নিকটবর্তী ‘ফাখ’ এলাকায় হোসেইন বিন আলী ও তাঁর বেশিরভাগ সহযোদ্ধা শহীদ হন। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার মতো এসব যোদ্ধার দেহ থেকে মস্তক কেটে আলাদা করে ফেলা হয় এবং রাজদরবারে ইমাম কাজেম (আ.)’র উপস্থিতিতে সকলের সামনে মস্তকগুলো প্রদর্শন করা হয়। ভর দরবারে ইমাম ছাড়া আর কেউ এই ঘটনার প্রতিবাদ করার সাহস দেখাননি। হোসেইন বিন আলীর মস্তক মুবারক দেখার পর ইমাম মুসা কাজেম (আ.) বলেন: ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। আল্লাহর শপথ হোসেইন শহীদ হয়েছেন। তিনি একজন মুত্তাকি ব্যক্তি ছিলেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতেন।

ইমামের এই সুস্পষ্ট অবস্থান ঘোষণায় কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেই ‘ফাখ’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তাই হাদি আব্বাসি সরাসরি ইমাম মুসা কাজেম (আ.)কে হত্যার হুমকি দিয়ে বলেন: যে মুসা ইবনে জাফারের নির্দেশে ‘ফাখ’ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে তাকে আমি হত্যা করবই। আব্বাসীয় শাসকের এই হুমকিতে ইমাম মোটেই বিচলিত হননি। কিন্তু হাদি আব্বাসি তার এই হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আগেই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন।
হাদির মৃত্যুর পর তার ২৩ বছর বয়সি ভাই হারুন ক্ষমতার মসনদে বসেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম ঘটনাবহুল যুগের সূচনা হয়। হারুন ২৩ বছর শাসনকাজ পরিচালনা করেন যার মধ্যে ১৫ বছর ছিল ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র ইমামতের যুগ। হারুনের শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে এবং ৪০টিরও বেশি প্রদেশ ইসলামি হুকুমতের অধীনে আসে। এসব প্রদেশের একটি ছিল ইরান এবং আরেকটি ছিল মিশর। বয়স কম থাকা এবং এত বিশাল সাম্রাজ্য হাতে পাওয়ার কারণে হারুনের মধ্যে মিথ্যা অহংকার বাসা বাঁধে।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, হারুনের মতো আব্বাসি স্বৈরশাসকরা পাঁচ শতাব্দিরও বেশ সময় ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসক থাকলেও তাদের শাসনকাজ পরিচালনায় রাসূলুল্লাহ (আ.) আদর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। উল্টো তারা ইসলাম বিরোধী কাজ করেছে বেশি। ঠিক এ কারণে রাসূলের বংশধর ইমামগণ এসব শাসকের বিরুদ্ধে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করার আগ পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেছেন। একদিন ইমাম মুসা কাজেম (আ.) বাগদাদে হারুনের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। এ সময় হারুন দম্ভভরে ইমামকে প্রশ্ন করেন: আমার এই প্রাসাদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম বলেন: এই ঘর হচ্ছে ফাসেকদের ঘর যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সূরা আরাফের ১৪৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “আমি আমার নিদর্শনসমূহ হতে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখি, যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে গর্ব করে। যদি তারা সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে ফেলে, তবুও তা বিশ্বাস করবে না। আর যদি হেদায়েতের পথ দেখে, তবে সে পথ গ্রহণ করে না। অথচ গোমরাহীর পথ দেখলে তাই গ্রহণ করে নেয়। এর কারণ, তারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা বলে মনে করেছে এবং তা থেকে বেখবর রয়ে গেছে। ”
হারুন এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন করেন: তাহলে এই ঘরের প্রকৃত মালিক কারা? ইমাম সঙ্গে সঙ্গে বলেন: যদি সত্য জানতে চাও তাহলে শোনো এটি আমার অনুসারীদের ঘর কিন্তু তা অন্যের দখলে চলে গেছে। এবার হারুন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন: তাহলে আপনারা এটি কেন ফিরিয়ে নিচ্ছেন না? উত্তরে ইমাম বলেন: সময় হলেই ফিরিয়ে নেব।
নিঃসন্দেহে ইমাম হারুনের কাছ থেকে তার প্রাসাদ ফিরিয়ে নিতে চাননি। তিনি বরং তিনি দখলদারদের কাছ থেকে খেলাফত ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। এই খেলাফত নবী বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র প্রাপ্য ছিল কিন্তু আব্বাসীয়রা হাজারো ছলচাতুরি ও হুমকি ধমকির মাধ্যমে দখল করে রেখেছিল।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।