সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯ ১৯:২১ Asia/Dhaka

হযরত মুসা কাজেম (আ.) রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতার পাশাপাশি আলেম তৈরিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেন।

 তাঁর হাতে তৈরি ছাত্রদের যেমন জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় অগাধ বিচরণ ছিল তেমনি মুসলিম উম্মাহর সেবা করার দিক দিয়েও তারা জনগণের মাঝে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এসব ছাত্রের জ্ঞান, অধ্যাবসায় ও ব্যক্তিত্বে ইমামের শত্রুদের এমনকি আব্বাসীয় শাসকদেরও চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। আব্বাসীয় খলিফারা জনগণের মাঝে এসব আলেমের গ্রহণযোগ্যতা দেখে ভয় পেয়ে যান। তারা ভাবেন, অত্যাচারের কারণে জনগণের মাঝে তাদের গ্রহণযোগ্যতা যেভাবে কমে গিয়েছে তাতে ইমাম মুসা কাজেমের ছাত্ররা যেকোনো সময় বিদ্রোহ করে বসতে পারে।

ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র অন্যতম ছাত্র ‘ইবনে আবি উমাইর’ ধর্মীয় জ্ঞানে এতটা পাণ্ডিত্য অর্জন করেন যে, শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সব আলেমের মধ্যে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ৯৪ বলে উল্লেখ করা হয় কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার জীবদ্দশায় এবং ইমাম রেজা (আ.)’র শাহাদাতের পর সেসব বই’র বেশিরভাগ লুট হয়ে যায়।

ইবনে আবি উমাইর সম্পর্কে প্রখ্যাত সুন্নি আলেম ‘জাহেয’ লিখেছেন: ইবনে উমাইর জ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। একবার গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা আব্বাসীয় শাসককে খবর দেয় যে, ইবনে উমাইর সব শিয়ার নাম জানে। নিরাপত্তা বাহিনী তখন তাকে আটক করে শিয়াদের নাম জানতে চায়। কিন্তু চরম নির্যাতনের মুখেও তিনি কারো নাম বলেননি। এ অবস্থায় তাকে নগ্ন করে দু’টি খেজুর গাছের মাঝখানে বেঁধে রেখে ১০০ ঘা চাবুক মারা হয়। কিন্তু তারপরও তিনি আব্বাসীয় শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে বিরত থাকতে রাজি হননি। প্রখ্যাত শিয়া আলেম শেখ মুফিদ লিখেছেন ইবনে উমাইরকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

মানুষের প্রতি সদাচারণের দিক দিয়েও ইবনে আবি উমাইরের নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। একবার এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে ১০ হাজার দেরহাম ঋণ নিয়েছিল।  কিন্তু ওই ব্যক্তি ঋণ শোধ করতে না পেরে নিজের বসতভিটা বিক্রি করে ইবনে উমাইরের কাছে ১০ হাজার দেরহাম নিয়ে আসে। ইবনে উমাইর একসঙ্গে তার কাছে এত অর্থ দেখে বিস্মিত হন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন এত অর্থ তিনি কোত্থেকে পেলেন? পিতার উত্তরাধিকার সম্পদ বা গুপ্তধনের সন্ধান পাননি তো? ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি জবাব দেন: না, আমি আমার বসতভিটা বিক্রি করে দিয়েছি। একথা শুনে ইবনে আবি উমাইর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন: ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলে গেছেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের বসতভিটাকে মুক্ত রাখতে হবে। তোমার কাছে আমার পাওনা প্রতিটি দেরহাম আমার প্রয়োজন। কিন্তু তারপরও এই টাকা আমি নেব না। তুমি টাকা ফেরত দিয়ে বসতভিটা ফিরিয়ে নাও।   

ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র আরেকজন প্রখ্যাত ছাত্রের নাম সাফওয়ান বিন মেহরান। তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এতটা বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন যে, সে যুগে তার লেখা বইগুলোকে আলেমরা রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করতেন। সাফওয়ান বিন মেহরান এতটা প্রজ্ঞা অর্জন করেছিলেন যে, ইমাম মুসা কাজেম (আ.) প্রায়ই ছাত্রদের সামনে উদাহরণ টানতে গিয়ে তার নাম উচ্চারণ করতেন। ইমামের আরেকজন ছাত্রের নাম ছিল সাফওয়ান বিন ইয়াহিয়া। বিখ্যাত আলেম শেখ তুসি তার সম্পর্কে লিখেছেন: আলেমদের মধ্যে ঈমান ও তাকওয়া’র দিক দিয়ে সাফওয়ানের তুলনা ছিল না। 

নবী পরিবারের অষ্টম নক্ষত্র ইমাম রেজা (আ.)’র যুগে সাফওয়ান ইমামের কাছে অনেক বড় মর্যাদা লাভ করেন। নবম ইমাম জাওয়াদ (আ.) সাফওয়ানের প্রশংসা করে বলেন: আমি তার প্রতি এতটা সন্তুষ্ট যে, দোয়া করি আল্লাহও যেন তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। সে কখনো আমার বা আমার পিতার নির্দেশ অমান্য করেনি বরং তা পালন করার জন্য ছিল সবচেয়ে বেশি তৎপর। ইমাম মুসা কাজেম (আ.) সাফওয়ানের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন: ইসলামে একজন মুসলমানের জন্য নেতৃত্বের পদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই। রাখালবিহীন ভেড়ার পালের মধ্যে দু’টি নেকড়েকে ছেড়ে দিলে তারা যা করে দু’জন মানুষ নেতৃত্ব লাভের জন্য তাই  করে থাকে। কিন্তু সাফওয়ান নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য মোটেও লালায়িত ছিল না।

ইমাম সাদেক (আ.) ও ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র আরেকজন বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন মোহাম্মাদ বিন আলী বিন নু’মান। তিনি এই দুই ইমামেরই প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) নু’মান সম্পর্কে বলেন: মোহাম্মাদ বিন নু’মান বিরুদ্ধ মতাদর্শের অনুসারীদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মনোনিবেশ করেন এবং বিজয়ী হন। সপ্তম ইমামের আরেকজন প্রখ্যাত ছাত্রের নাম হিশাম বিন হাকাম। চতুর্থ হিজরি শতকের প্রখ্যাত বই বিশারদ ‘ইবনে নাদিম’ তার সম্পর্কে বলেন: হিশাম ছিলেন এমন একজন আলেম যিনি ইসলামি জ্ঞানে উচ্চমানের পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। যেকোনো দ্বীনি প্রশ্ন বিশেষ করে ইমামত সম্পর্কিত যেকোনো প্রশ্নের উত্তর তিনি অনর্গল ভাষায় দিয়ে যেতেন যাতে এ সম্পর্কে কারো কোনো সংশয় বা প্রশ্ন না থাকে।

ইমাম মুসা কাজেম (আ.) সম্পর্কিত আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি আমরা। সার্বিকভাবে তাঁর সম্পর্কে বলা যায়, তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে আব্বাসীয় শাসকদের বিরুদ্ধে শক্ত ও আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি এসব স্বৈরশাসকের আগ্রাসী ও জালিম চেহারা জনগণের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছিলেন। হারুন আব্বাসি এই পরিস্থিতিকে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক বলে মনে করেন। তাই তিনি সপ্তম ইমামকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কুফা ও বসরার কারাগারে আটক থাকার সময় ইমাম কারারক্ষীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে নিজের অনুসারীতে পরিণত করেন।

এ খবর শোনার পর হারুন ইমাম মুসা কাজেম (আ.)কে বাগদাদের একটি কুখ্যাত কারাগারে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন এবং সেখানে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। এই কারাগারে বেছে বেছে সবচেয়ে নিষ্ঠুর কারারক্ষীদের নিয়োগ দেয়া হয় যাতে তারা ইমামের কথায় প্রভাবিত না হয়। কিন্তু ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েও ইমামের প্রতিরোধকামী মানসিকতায় ফাটল ধরাতে না পেরে হারুন ইমামকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করার নির্দেশ দেন। সে নির্দেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয় এবং এভাবেই ১৮২ হিজরির ২৫ রজব বাগদাদের কারাগারে নবী বংশের সপ্তম নক্ষত্র ইমাম মুসা কাজেম (আ.) শাহাদাতবরণ করেন। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ