সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯ ২০:০০ Asia/Dhaka

তিনি ১৪৮ হিজরির ‌১১ জিলকদ মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম রাখা হয় আলী এবং পরবর্তীতে তিনি রেজা উপাধিতে ভূষিত হন।

পিতার শাহাদাতের পরপরই প্রায় ৩৫ বছর বয়সে তিনি ইমামতের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ইমাম রেজা (আ.)’র মূল ঘাঁটি মদীনায় হলেও তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি মাঝেমধ্যে মক্কা, ইরাক ও ইরান সফর করতেন। তাঁর ২০ বছরের ইমামতের যুগকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ হচ্ছে ইমামতের প্রথম ১০ বছর যখন খলিফা হারুন আব্বাসির জুলুম অত্যাচার মুসলিম জাহানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পরের ভাগে রয়েছে পরবর্তী পাঁচ বছর যখন হারুনের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে আমিন আব্বাসি শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেন। তৃতীয় ভাগ হচ্ছে ইমামের জীবনের শেষ পাঁচ বছর যখন আমিনের বড় ভাই মামুন আব্বাসি ক্ষমতা গ্রহণ করে মুসলিম বিশ্বের ওপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।

এই তিন যুগেই ইমাম রেজা (আ.) বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে ইমামতের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পূর্বপুরুষদের মতো অষ্টম ইমাম যে সাধারণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন তা হলো, স্বৈরাচারী শাসকরা ইসলামের লেবাস পরে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে মুসলিম সমাজে শাসনকাজ পরিচালনা করছিল। আব্বাসীয় শাসকরা চাপপ্রয়োগ ও হুমকি-ধমকির মাধ্যমে জনগণকে ইমামদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও ইসলামের সত্যিকারের ধারক ও বাহক ইমামদের সুমধুর ব্যবহার ও দয়া জনগণকে তাঁদের কাছে টেনে আনত।

আব্বাসীয় শাসকরা তাই সব সময় ইমামের নেতৃত্বে বিদ্রোহের আশঙ্কায় তটস্থ থাকত।  বাদশাহ হারুন ইমাম মুসা কাজেম (আ.)কে মদীনা থেকে বাগদাদে এনে কারাগারে নিক্ষেপ করেও নিজের শাসনকে নিরাপদ মনে করেননি বরং কারারক্ষীদের মাধ্যমে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় কারাকারেই বিষপ্রয়োগে ইমামকে শহীদ করেন। এরপর এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিয়ে হারুন জনগণের মাঝে একথা প্রচার করেন যে, কারাগারে ইমামের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

ইমাম রেজা (আ.) ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণের পর একদিকে শাসকগোষ্ঠীর দিকভ্রান্ত ইসলাম এবং অন্যদিকে শিয়াদের পথভ্রষ্ট কিছু দলের মুখোমুখি হন। তিনি খাঁটি মোহাম্মাদি ইসলামের স্বরূপ তুলে ধরে এই দুই বিপদ থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অষ্টম ইমাম তাঁর এই সংগ্রামকে গোপন না রেখে প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেন। এর ফলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা ইমামের জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যান। তারা ইমামকে তাঁর পূর্বপুরুষদের মতো গোপনে নিজের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। সাফওয়ান বিন ইয়াহিয়া এ সম্পর্কে বলেন: আমরা ইমামকে বাদশা হারুনের ব্যাপারে সাবধান হওয়ার অনুরোধ করলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন: হারুন যত চেষ্টাই করুক সে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

হারুনের মৃত্যুর পর তার প্রিয় স্ত্রী জুবাইদার সন্তান মোহাম্মাদ আমিন আব্বাসি মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু পাঁচ বছরের শাসনামলে তাকে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয় যার মধ্যে নিজের বড় ভাই মামুনের বিদ্রোহ ছিল অন্যতম। এই বিদ্রোহ ও সংঘাতের সুযোগে ইমাম রেজা (আ.) জনগণের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আরো বেশি শক্তিশালী করেন এবং তাদের সামনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম এ সময় আমিন আব্বাসির শাসনকাল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। তিনি বলেন, আমিন তার ভাই মামুনের হাতে নিহত হবেন। ইমামের এ কথা তখন সবার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই মোহাম্মাদ আমিন আব্বাসিকে হত্যা করে শাসনক্ষমতা দখল করেন তার বড় ভাই মামুন আব্বাসি।

মামুন ক্ষমতা গ্রহণ করেই একটি কঠিন বাস্তবতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন। আর তা হলো নির্বিঘ্নে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে গেলে তার দরবারে এমন একজন যোগ্য আলেম ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি প্রয়োজন যার অভাব দরবারে তখন উপস্থিত চাটুকার ও মোসাহেব আলেমদের দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে মামুন একথাও জানতেন যে, জনগণের মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ দিন দিন বাড়ছে এবং ইমাম রেজা (আ.) মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। এ কারণে বাদশা মামুন ইমামকে মদীনা থেকে তৎকালীন রাজধানী মার্ভ শহরে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। মামুন এ কাজের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা করেন। একদিকে নিজ দরবারের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের অভাব পূরণ করা এবং অন্যদিকে আব্বাসীয় শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণকে শান্ত করার কাজে ইমামের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করা।

জনগণ যাতে বুঝতে না পারে যে, ইমামকে জোরপূর্বক মদীনা থেকে মার্ভে নিয়ে আসা হচ্ছে সেজন্য কৌশল অবলম্বন করেন বাদশা মামুন। তিনি রাজদরবারের পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদলকে মদীনায় পাঠান এবং তারা সসম্মানে ইমাম রেজা (আ.)কে নিয়ে বিশাল কাফেলা সহকারে মার্ভের দিকে যাত্রা করেন। ইমামের এই আড়ম্বরপূর্ণ যাত্রার কথা মুহূর্তের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণ যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে এই মহান ইমামের বক্তব্য শোনার জন্য সমবেত হয়। হিজাজ থেকে বসরা পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে ইমাম জনগণকে ইসলাম সম্পর্কে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি তাদের মাঝে দিকনির্দেশামূলক বক্তব্য রাখেন।

সে যুগে নিশাবুর ছিল ইসলামের জ্ঞান চর্চার অন্যতম সেরা কেন্দ্র। ইমামের যাত্রাপথে এই শহরের আলেমদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ইমামের মুখনিসৃত বাণী শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। ইমাম রেজা (আ.) আধ্যাত্মিক সুষমামণ্ডিত ও আকর্ষণীয় চেহারা নিয়ে হাজার হাজার জনতার সামনে উপস্থিত হন। অত্যন্ত সাধাসিধে পোশাক পরিহিত ইমাম বক্তৃতার শুরুতেই ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস বা তৌহিদ নিয়ে কথা বলেন। তিনি রাসূলের পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী যা বংশ পরম্পরায় ইমামদের মাধ্যমে তাঁর কাছে পৌঁছেছিল সেটি উচ্চারণ করেন। ইমাম রাসূলের মাধ্যমে শোনা আল্লাহ তায়ালার বাণী উদ্ধৃত করে বলেন: “কালিমা লা ইলাহা ইল্লাহ হচ্ছে আমার দূর্গ। যে কেউ এই কালিমা উচ্চারণ করবে সে আমার দূর্গে প্রবেশ করবে এবং যে আমার দূর্গে প্রবেশ করবে তাকে আমার আজাব স্পর্শ করবে না।”

এরপর ইমাম আরো বলেন, কিন্তু আল্লাহর এই দূর্গে প্রবেশ করার শর্ত হচ্ছি আমরা ইমামগণ। ইমামগণ যদি মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাহলে সমাজে থেকে সব ধরনের শিরক, কুফর ও নিফাক দূর হয়ে যাবে এবং সর্বত্র আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম রেজা (আ.) খলিফা মামুনের শাসনক্ষমতার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ