অক্টোবর ০৫, ২০১৯ ১৬:৩২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, ইমাম মুসা রেজা (আ.) নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাদশাহ মামুনের নির্দেশে মদীনা থেকে খোরাসান যাত্রা করেন।

পথিমধ্যে নিশাবুর শহরে তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে এক তৌহিদি ভাষণ দান করেন। ইমাম বলেন, যে কেউ আল্লাহর একত্ববাদের ছায়াতলে আশ্রয় নেবে সে আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা পাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, ইমামগণ যতদিন শাসনক্ষমতা হাতে না পাবেন ততদিন মুসলিম বিশ্বে একত্ববাদের সংস্কৃতি অনুপস্থিত থাকবে। ইমাম এ বক্তব্যের মাধ্যমে মামুনের শাসনক্ষমতার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন।

নিশাবুর থেকে বের হওয়ার পর ইমামের কাফেলা ২০১ হিজরির ১০ শাওয়াল  খলিফা মামুনের শাসনক্ষমতার রাজধানী মার্ভ শহরে প্রবেশ করে। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মামুন তার পারিষদবর্গকে নিয়ে ইমামকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর রাজপ্রাসাদে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জনগণকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে মামুন ইমাম রেজা (আ.)কে মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। ইমাম আগে থেকেই মামুনের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তিনি জানতেন, ইমামের ব্যক্তিত্ব ও জনগণের মাঝে তাঁর প্রভাব খর্ব করার অশুভ উদ্দেশ্যে মামুন এ প্রস্তাব দিয়েছেন।

তাই তিনি এ প্রস্তাবের জবাবে স্পষ্ট ভাষায় মামুনকে বলেন: “যদি খেলাফত তোমার অধিকার বা প্রাপ্য হয়ে থাকে তাহলে শাসনকর্তার পোশাক খুলে তুমি তা অন্য কারো গায়ে পরাতে পারো না। আর যদি খেলাফত তোমার প্রাপ্য হয়ে না থাকে তাহলে যে জিনিসে তোমার কোনো অধিকার নেই তা তুমি কীভাবে অন্যকে দান করার প্রস্তাব দিতে পারো?” খলিফা মামুন এ ধরনের উত্তর আশা করেননি। উত্তর শুনে তিনি হুমকি দিয়ে ইমামকে বলেন, আপনাকে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে। ইমাম এ হুমকির জবাবে আবারো এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

কারো কারো মনে এ প্রশ্ন আসতে পারে, যখন খলিফা নিজে ইমামের কাছে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চাইলেন তখন তিনি কেন তা গ্রহণ করেননি? এর উত্তর হচ্ছে- ইমাম রেজা (আ.) তাঁর দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে একথা বুঝতে পেরেছিলেন, নিজের ভাই ‘আমিন আব্বাসি’কে হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণকারী মামুন সুদূরপ্রসারি কোনো চক্রান্ত ছাড়া এ ধরনের প্রস্তাব দেননি। তিনি আপাতত জনরোষ প্রশমনের জন্য এ প্রস্তাব দিলেও চূড়ান্তভাবে ইমামের ক্ষতি করাই তার উদ্দেশ্য। ইমাম খেলাফতের দায়িত্ব নিতে চাইলেই মামুন জনগণকে একথা বোঝাত যে, তোমাদের ইমাম শাসনক্ষমতার কাঙ্গাল ছিল এবং সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার করেছে। সেইসঙ্গে মামুনের শাসনামলে জনগণের ওপর যত জুলুম, অন্যায় ও অত্যাচার হয়েছিল তার সব দায়ভার ইমামের ওপর চাপানোও ছিল মামুনের এ প্রস্তাবের অন্যতম উদ্দেশ্য।

এ ছাড়া, ইমাম জানতেন যে কেউ মামুনের খেলাফতের দিকে চোখ তুলে তাকাবে তাকে তার ভাই আমিন আব্বাসির পরিণতি ভোগ করতে হবে। খলিফা হারুন শাসনক্ষমতা তার অপর ছেলে আমিনকে দিয়ে গেলেও পিতার মৃত্যুর পর মামুন প্রবল যুদ্ধের মাধ্যমে আমিনকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এরপর মামুন নিজের ভাই আমিনের খণ্ডিত মস্তক খোরাসানের রাস্তায় রাস্তায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রদর্শন করেন যাতে আর কেউ তার শাসনক্ষমতার দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস না পায়। এরপরও হয়তো কারো কারো মনে এই প্রশ্ন থেকেই যাবে যে, খলিফা হুমকি দেয়ার পরও কেন ইমাম খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি?

এ প্রশ্নের উত্তরে একটি ঘটনা উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, পরবর্তীতে খলিফা মামুন একবার ইমামকে ঈদের নামাজ পড়ানোর অনুরোধ করেন। ইমাম সে অনুরোধ গ্রহণ করলে জনগণ দলে দলে ঈদগাহের দিকে ধাবিত হয়। গোয়েন্দাদের কাছে এ ঘটনার খবর পেয়ে গণবিদ্রোহের ভয়ে মামুন ঈদগাহে যাওয়ার পথে ইমামকে আটকে দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে ঈদের নামাজ পড়িয়ে নেন। এখান থেকে বোঝা যায়, মামুন ইমাম রেজা (আ.)’র জনপ্রিয়তাকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন।

এ ছাড়াও, ইমাম যদি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন তাহলে তাকে দু’টি কাজের যেকোনো একটি করতে হতো। হয় তাঁকে মামুনের জালেম শাসনব্যবস্থার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সব রাষ্ট্রীয় পদ আকড়ে থাকা দুর্নীতিবাজ লোকদের অপসারণ করতে হতো। এটি করতে গেলে ইমামকে ভয়াবহ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হতো। অথবা ইমামকে মামুনের জালিম শাসনব্যবস্থার কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে  শাসনকাজ পরিচালনা করতে হতো যা ছিল ইমামের ব্যক্তিত্ব ও তাকওয়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।  সমাজে বিদ্যমান জুলুম, অত্যাচার ও অন্যায় মেনে নিয়ে শাসনকাজ  পরিচালনা করা ইমাম রেজা (আ.)’র পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কাজেই ইমাম খেলাফত গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মামুনের শাসনক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহকে এ শিক্ষা দিয়ে যান যে, তারা যেন কখনো ইসলামের লেবাসধারী মুনাফিক চরিত্রের শাসকদের ধোঁকায় না পড়ে। ইমাম খলিফা মামুনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর মামুন অপমানবোধ করেন এবং নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য এবার যুবরাজ বা খলিফার স্থলাভিষিক্তের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ইমামকে হত্যা করা হবে।

খলিফা মামুনের এই পীড়াপীড়ির উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মাঝে নিজের শাসনক্ষমতাকে বৈধতা দেয়া। সে সময় আব্বাসীয় শাসকদের অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল এবং ইমাম রেজা (আ.)’র চেয়ে জনপ্রিয় আর কেউ ছিল না। এ অবস্থায় ইমাম যদি যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাহলে জনরোষ কিছুটা হলেও প্রশমন করা যাবে। জনগণ এটা ভেবে সন্তুষ্ট থাকবে যে, তাদের ইমাম রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। পাশাপাশি ইমাম এ দায়িত্ব গ্রহণ করলে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারির কারণে জনগণের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও কমে যাবে এবং জনেগণের মাঝে তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব কমে আসবে।

ইমাম রেজা (আ.) যখন দেখলেন যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া আর কোনো গতি নেই তখন তিনি এমন কিছু শর্তে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন যাতে জনগণ বুঝতে পারে তিনি বাধ্য হয়ে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং এটি গ্রহণ করার কোনো ইচ্ছা বা অভিসন্ধি তার ছিল না। ইমাম আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) বলেন: “যদি আমাকে বাধ্য হয়ে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় তাহলে আমার শর্ত হচ্ছে, শাসনকাজ, বিচারকাজ, রাষ্ট্রীয় ফতোয়া প্রদান, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ বা বরখাস্ত করার মতো কাজ থেকে আমি বিরত থাকব।” খলিফা মামুন ইমামের এ শর্ত মেনে তাকে যুবরাজ ঘোষণা করেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ