সুরা আ'লার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও ব্যাখ্যা
সুরা আল আ'লা পবিত্র কুরআনের ৮৭ তম সুরা। মক্কি এ সুরায় রয়েছে ১৯ আয়াত। মহান আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা তুলে ধরা এবং তাঁর সাতটি বৈশিষ্ট্য এই সুরার কয়েকটি প্রধান আলোচ্য বিষয়।
অস্তিত্বের জগতে শৃঙ্খলা ও নিয়মের বিধান এবং পথ দেখানোর ব্যবস্থা, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আত্মগঠন আর হযরত ইব্রাহিম ও হযরত মুসার ওপর নাজেল হওয়া আসমানি গ্রন্থ নিয়েও বক্তব্য রয়েছে সুরা আল আ'লায়।
সুরা আল আ'লা শুরু হয়েছে মহান আল্লাহর প্রশংসা করার ও তার অতুলনীয় গুণগুলো স্মরণ করার আহ্বানের মধ্য দিয়ে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর পবিত্র নামগুলোকে কখনও মূর্তি, দেব-দেবি বা ভুয়া খোদাগুলোর নামের সারিতে রাখা উচিত নয়। মহান আল্লাহ সব ধরনের ত্রুটি, অপূর্ণতা ও সৃষ্টির কোনো গুণ বা অবস্থার সাদৃশ্য থেকে মুক্ত। মহামহিম আল্লাহ কোনো ব্যক্তি, বস্তু ও কল্পনা করা যায় এমন যে কোনো কিছু এবং প্রকাশ্য ও গোপন যে কোনো শির্ক বা অংশীবাদীতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত। মহান আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব-জগত ও অস্তিত্বের জগত তথা সব সৃষ্টি।
মহান আল্লাহ গোটা অস্তিত্বের জগৎ ও এর সবকিছুকে সৃষ্টিকে করেছেন এবং এসবকে করেছেন বিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল। তিনি এসব কিছুকে উন্নতির পথ দেখান। মহান আল্লাহ মায়ের হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছেন সন্তানের জন্য গভীর স্নেহ ও ভালবাসা। মায়ের বুকে তিনিই যুগিয়েছেন শিশুর খাবার। নবজাতককে তিনি দিয়েছেন মায়ের স্তন থেকে দুধ পানের ইচ্ছা। এভাবে প্রত্যেক সৃষ্টিকে পথ দেখান মহান আল্লাহ। অন্যদিকে তিনি মানুষের জন্য দিয়েছেন জীবন-বিধান ওহি বা প্রত্যাদেশ পাঠিয়ে এবং নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন এই বিধান শেখাতে ও বাস্তবায়ন করতে। প্রথমোক্ত পথ প্রদর্শনকে বলা হয় হেদায়াতে তাকভিনি বা সত্তাগত বা প্রকৃতিগত পথ প্রদর্শন। আর দ্বিতীয় ধরনের পথ প্রদর্শন হচ্ছে হেদায়াতে তাশরিয়ি বা আইনি তথা বিধানগত পথ-প্রদর্শন। এ দুইই পরস্পরের পরিপূরক।
মহান আল্লাহই মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন উপকারী নানা জন্তু ও গাছপালা। মাটির নীচ থেকে তিনিই জাগিয়ে তোলেন উদ্ভিদ। তাই মানুষের হওয়া উচিত তার প্রভু, স্রস্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। সুরা আল আ'লায় এসবের ইঙ্গিত রয়েছে।

মহান আল্লাহ সব সৃষ্টিকে দিয়েছেন প্রকৃতিগত দিশা। আধুনিক যুগেও বিজ্ঞানীরা বিস্মিত যে কিভাবে নানা প্রাণী বিচিত্রময় ও বিস্ময়কর দক্ষতা অর্জন করে? অভিবাসী পাখিরা কখনও কখনও হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নানা মহাদেশ, মহাসাগর ও বন-জঙ্গল, পাহাড় ও সমতল প্রান্তর পেরিয়ে আবারও নিজ নীড়ে নিখুঁতভাবে ফিরে আসে! কিভাবে তারা কখনও পথ হারায় না? কিভাবে তারা নিজ আবাসভূমির অঞ্চলকে ঠিকই চিনে নেয়? একইভাবে মৌমাছিরাও অনেক দূরে যাওয়ার পরও বা প্রবল বাতাসে এদিক-সেদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেও পরে ঠিকই নিজ ঘর বা চাকে ফিরে আসে! অথচ মানুষকে খুব দূর থেকে নিজ ঘর বা বাসভবনে ফিরে আসতে হলে সঠিক ঠিকানা জানতে হয় বা পথ-প্রদর্শকের সাহায্য নিতে হয়।
কোনো কোনো ছোট মাছ বহু বছর ধরে সাগরে বসবাসের পর ডিম পাড়ার সময় হলে ফিরে আসে ঠিক সেই নদী বা খালে যেখানে সে জন্ম নিয়েছিল। এরপর ডিম পেড়ে সে আবারও সাগরে নিজ এলাকায় ফিরে আসে। এসব মাছ স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে চলে নিজের আসল দেশ বা জন্ম-স্থানে ফিরে যায় যা তাদের প্রতিপালনের জন্য বেশি উপযোগী। বহু বছর দূরে থাকার পরও তারা ঠিকই নিজ জন্ম-স্থানকে খুঁজে চিনে নিতে পারে।
সুরা আল আ’লার ১৪ ও ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, (১৪) নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে যে পরিশুদ্ধ হয় (১৫) এবং যে তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামায আদায় করে।
পরিশুদ্ধি বলতে এখানে ব্যাপক অর্থে সংশোধনকে বোঝানো হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে আত্মাকে সব ধরনের শির্ক বা অংশীবাদিতা ও কু-প্রবৃত্তি বা কু-অভ্যাসগুলো থেকে মুক্ত রাখা, হালাম ও হারামের বিধানগুলো মেনে চলা, জাকাত দিয়ে সম্পদ পবিত্র করা- ইত্যাদি। জাকাত দেয়া হলে ও আল্লাহর পথে সম্পদ খরচ করা হলে মানুষের মন ও প্রাণ পবিত্র হয়।

কুপ্রবৃত্তি বা নাফসের উচ্চাভিলাসকে দমন করতে চাইলে মহান আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে ও নামাজ আদায় করতে হবে। একইসঙ্গে মন থেকে দূর করতে হবে দুনিয়ার আসক্তি। কারণ দুনিয়া-প্রেমই হল সব পাপের উৎস। সম্পদ ও পদের আসক্তি, দৈহিক বা জৈবিক ভোগবিলাস এবং যৌন-বিলাসিতা-এসবই দুনিয়া-প্রেমের দৃষ্টান্ত। এসবে যদি ভারসাম্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তাহলে মানুষ পাপে জড়ায়। এ অবস্থায় তারা পার্থিব জীবনকে পরকালীন জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে মানুষ আত্ম-পরিচিতি ভুলে গিয়ে বিবেকহীন হতে থাকে। বিবেকে যখন তালা পড়ে তখন তারা চিরস্থায়ী জীবনের সুখ-শান্তিকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য বিসর্জন দেয়ার মত চরম বোকামি করে।
সুরা আল আ’লার শেষের আয়াতে বলা হচ্ছে যে পরকালের স্থায়ী ও উৎকৃষ্ট জীবনের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি মানবজাতির এক পুরনো স্বভাব। এই বাস্তবতাটি অতীতের দুই মহান রাসুল হযরত ইব্রাহিম ও হযরত মুসার কাছে নাজিল হওয়া খোদায়ি কিতাব বা ওহির গ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছিল। আসলে সব নবী-রাসুলের প্রচারিত মূল শিক্ষায় বলা হয়েছে যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মহান আল্লাহর দাসত্বের জন্য তথা আল্লাহর ইবাদতের জন্য। তাই মানুষের সব কাজের লক্ষ্য হতে হবে মহান আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।
কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ জেনে-শুনেও এই দায়িত্বকে উপেক্ষা ও পদদলন করছে। মনের কুমন্ত্রণার কাছে নতি স্বীকার করে তারা নানা পাপে জড়ায়। তাই সব পাপের মূল শেকড়গুলো কেটে দেয়ার জন্য আত্মগঠন ও আত্ম-সংশোধনের কোনো বিকল্প নেই। পার্থিব দুনিয়া বৃহত্তম দুনিয়ায় যাবার একটি ক্ষণস্থায়ী করিডোর বা ক্ষুদ্র সেতু। ইহকালকে এমন এক জমিন হিসেবে দেখা উচিত যেখানে ভালো কিছু করা বা ভালো গাছের চারা লাগালে বা বীজ বপন করলে কিংবা মন্দ কাজের মাধ্যমে মন্দ গাছের চারা বা বীজ বপন করলে এসবের সুফল ও কুফল দেখা যাবে পরকাল বা আখেরাতে।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/২২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।