অক্টোবর ২৪, ২০১৯ ১৬:০১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, ইমাম রেজা (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পর বাদশা মামুন ইমামকে হুমকি দিয়ে যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করেন।

তবে ইমামও দায়িত্ব গ্রহণের আগে এই শর্ত প্রয়োগ করেন যে, খেলাফতের কোনো দায়িত্বে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। এভাবে তিনি জনগণকে পরোক্ষভাবে একথা বুঝিয়ে দেন যে, তাকে যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে।

এখানে কারো কারো মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, ইমাম হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, যেদিন ইমামকে মদীনা থেকে জোর করে মার্ভ শহরে নিয়ে আসা হয় সেদিনই ইমাম জানতেন তিনি আর মদীনা শহরে ফিরে যেতে পারবেন না এবং মামুনের হাতেই তাঁর মৃত্যু হবে। এ বিষয়টি জানতেন বলেই তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করে আনেননি। দ্বিতীয়ত, ইসলামি সংস্কৃতিতে শাহাদাত আল্লাহ তায়ালার কাছে একটি অতি উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় এবং আল্লাহপ্রেমী সব মুত্তাকি ব্যক্তি শাহাদাত কামনা করেন। কাজেই, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মামুনের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রাণ দেয়া বা শহীদ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ইমাম যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তবে ইমাম একথা জানতেন যে, এমন সময় শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করা উচিত যখন এই শাহাদাতের বদৌলতে সত্য প্রতিষ্ঠা এবং মিথ্য অপসৃত হবে।

ইমাম রেজা (আ.) যদি খেলাফতের রাজধানী শহর মার্ভে পৌঁছামাত্র মামুনের বিরুদ্ধাচরণের চূড়ান্ত মাত্রা প্রদর্শন করতেন তাহলে শাসক মামুন নিশ্চিতভাবে তার হুমকি বাস্তবায়ন করতো এবং ইমামকে হত্যা করত। সেক্ষেত্রে ইমাম তার বৃহৎ লক্ষ্য অর্জন করা ছাড়াই শহীদ হয়ে যেতেন এবং তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হতো না। কাজেই ইমামের জন্য সুচিন্তিত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেভাবে অগ্রসর হওয়া ছিল সে সময় সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমানের কাজে।  

কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) এই সময়ে দ্বিমুখী বিপদের মুখে পড়েন। একদিকে বাদশা মামুন ইমামের অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছিল। অন্যদিকে পিতা ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র তিনজন বিশ্বস্ত প্রতিনিধির বিশ্বাসঘাতকতা ইমামকে পীড়া দিচ্ছিল। ওই তিন প্রতিনিধি ছিলেন আলী বিন হামজা বাতায়ি, জিয়াদ বিন মারওয়ান কেন্দি এবং ওসমান বিন ঈসা রাওয়াসি। বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের সকল শিয়া মুসলমান তাদের যাকাত ও খোমসের অর্থ ও সম্পদ এই তিন ব্যক্তির কাছে জমা দিতেন এবং তারা এই অর্থ ইমাম মুসা কাজেম (আ.)’র কাছে পৌঁছে দিতেন। বাদশা হারুনের নির্দেশে ইমাম মুসা কাজেম (আ.) কারাগারে শাহাদাতবরণ করার পর ওই তিন প্রতিনিধি পরস্পরের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে এই বিশাল অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করেন।

তারা এই বলে ভ্রান্ত যুক্তি দেখান যে, ইমাম মুসা কাজেম কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যাননি। এই তিন বিশ্বাসঘাতক প্রতিনিধি ইমাম রেজা (আ.)’র ইমামতকে বেমালুম অস্বীকার করেন। তারা ‘ওয়াকিফিয়া’ নামক একটি মতবাদ চালু করে দাবি করেন, ইমাম মুসা কাজেম (আ.) ছিলেন আসলে হযরত মাহদি এবং তিনি একদিন পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করবেন। এ অবস্থায় ইমাম রেজা (আ.)’র কর্তব্য বহুগুণ বেড়ে যায়। একদিকে জনগণের সামনে শাসক মামুনের জুলুম ও ষড়যন্ত্র উন্মোচন করে দেয়া এবং অন্যদিকে পিতার তিন প্রতিনিধির ভ্রান্ত মতবাদের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার জোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে ইমাম রেজা (আ.) যদি যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণ না করে শাহাদাতের পথ বেছে নিতেন তাহলে বিশ্বাসঘাতক ওয়াকিফিয়া-পন্থিদের প্রচারণার মুখে সপ্তম ইমাম পর্যন্ত এসে ইমামতের ধারা বন্ধ হয়ে যেত। এ কারণে ইমাম সুদূরপ্রসারি কৌশল হিসেবে যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন শাসক মামুন ইমামের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে পেরে না উঠে ২০২ হিজরিতে ইমাম রেজা (আ.)কে ঈদুল ফিতরের নামাজের ইমামতি করতে অনুরোধ করেন। ইমাম রেজা মামুনের এই প্রস্তাবের পেছনের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করে প্রথমে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মামুন পীড়াপিড়ি শুরু করলে ইমাম তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। মামুন ভেবেছিলেন, আজ সাধারণ মুসল্লিরা এই ভেবে খুশি হবে যে, ইমাম রেজা (আ.)কে নামাজের ইমামতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে তারা মামুনকে ধন্যবাদ জানাবেন। কিন্তু বাস্তবে হয় তা উল্টো।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ঈদের দিন সকালে মামুনের পক্ষ থেকে তার নিজের সুসজ্জিত ঘোড়া, পারিষদবর্গ ও সরকারি দামি পোশাক ইমামের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ইমাম এসবের কিছু গ্রহণ না করে সাধারণ পোশাকে খালি পায়ে ঈদগাহের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। ইমামের অনুসারীরাও তাঁর সঙ্গে হাঁটতে থাকেন। ইমাম এক পর্যায়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন ‘আল্লাহু আকবার’। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গিসাথীরাও সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বলেন ওঠেন, আল্লাহু আকবার। ইমাম যতই ঈদগাহের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজনের সংখ্যাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ অবস্থায় খলিফার গোয়েন্দারা মামুনকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেয় যে, ইমাম রেজা যদি এভাবে ঈদগাহে পৌঁছাতে পারেন এবং খুতবা দিতে পারেন তাহলে এই জনতাকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং তারা আজই বিদ্রোহ করে খলিফার গদি উল্টে দিতে পারে।

মামুন তাৎক্ষণিকভাবে ইমামের কাছে দূত মারফত পত্র পাঠায় যাতে লেখা ছিল- ‘আপনি যদি এভাবে অগ্রসর হতে থাকেন তাহলে আপনি আরো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন ও আপনার কষ্ট বেড়ে যাবে। কাজেই নিজেকে আপনি আর কষ্ট দেবেন না। আপনার ঈদগাহে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য কাউকে নামাজ পড়ানোর জন্য পাঠানো হচ্ছে।” পত্র পাওয়া মাত্র ইমাম সম্মিলিত জনতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অর্ধেক পথ থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। এ পরিস্থিতি দেখে মামুনের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে উপস্থিত লোকজনের আর কষ্ট হয়নি।

এই ঘটনার পর মামুনের শাসনের বিরুদ্ধে সারাদেশে বিদ্রোহের সূচনা হয়। হযরত আলী (আ.)’র যুগের খারেজিদের মতো একটি গোষ্ঠী বের হয় যারা মামুন ও ইমাম রেজা (আ.)’কে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। কিন্তু নিজের গোয়েন্দা বাহিনীর কাছ থেকে খবর পেয়ে মামুন ওই গোষ্ঠীর হামলার হাত থেকে বেঁচে যান। একইসঙ্গে তিনি ইমাম রেজা (আ.)কে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য তিনি এক অনুষ্ঠানে ইমামকে বিষমিশ্রিত ফল খেতে দেন। বিষাক্ত ফল খেয়ে ২০৩ হিজরির ৯ই সফর ইমাম রেজা (আ.) শাহাদাতবরণ করেন। জনগণকে ধোকা দেয়ার উদ্দেশ্যে মামুন নিজের পিতা হারুনের কবরের পাশে ইমামের মরদেহ দাফনের নির্দেশ দেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ