অক্টোবর ২৮, ২০১৯ ২০:৫৪ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, খলিফা মামুন ইমাম রেজা (আ.)কে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মামুনের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী ইমাম কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তাঁকে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়। আজকের আসরে আমরা ইমামতের আধ্যাত্মিক ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পর্কে এই মহান ইমামের বক্তব্য শুনব।

ইমাম রেজা (আ.) মদীনার অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও জীবনের শেষগুলোতে বাদশা মামুন তাকে জোর করে নিজের রাজধানী শহর মার্ভে নিয়ে এসে যুবরাজের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছিল।  ইমাম শাসনকাজে হস্তক্ষেপ না করার শর্তে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যখন মার্ভ শহরে অবস্থান করছিলেন তখন একদিন শহরের জামে মসজিদে একদল মানুষ ‘ইমামত’ নিয়ে আলোচনায় জড়িয়ে যায়। সেখানে প্রত্যেকে ইমামত সম্পর্কে তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে এবং এর ফলে ব্যাপক মতানৈক্য দেখা দেয়। তারা নিজেদের জন্য ইমাম নির্বাচন করতে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটায়।

এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী এ সম্পর্কে বলেন: আমি মসজিদে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হতে দেখে দৌড়ে ইমামের কাছে যাই এবং তাকে সব খুলে বলি। ইমাম আমার কথা শুনে মুচকি হেসে বলেন: এই মানুষগুলো ইমামতের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করেনি। ইমামতের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অবগত থাকলে তারা বিষয়টিকে এত হাল্কা করে ফেলত না। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার পাশাপাশি দ্বীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার পর তাঁর প্রিয় রাসূলকে নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছেন। বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে বিশ্বনবী (সা.)’র ওপর সূরা মায়েদার তিন নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয় যার একাংশে বলা হয়েছে: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।”

ইমাম রেজা (আ.) আরো বলেন, ইমামত হচ্ছে দ্বীন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এবং বিশ্বনবী (সা.) রেহলাতের আগে দ্বীনের লক্ষণগুলি উম্মাতের জন্য বর্ণনা করে গেছেন। তিনি মুসলিম উম্মাহকে তাদের চলার পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন এবং এই পথে চলার জন্য ইমাম আলী (আ.)কে তাদের নেতা হিসেবে মনোনিত করে রেখে গেছেন। আল্লাহর রাসূল (আ.) উম্মতের প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ই বলে যেতে ভুল করেননি। কাজেই কেউ যদি মনে করে বিশ্বনবী (সা.) ইমামত সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে যাওয়ার পরও দ্বীন পূর্ণাঙ্গ হয়নি তাহলে সে যেন আল্লাহর কিতাবের শিক্ষাকে অস্বীকার করল।

যারা মার্ভের জামে মসজিদে ইমামতের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে কোনো ধারনা না নিয়েই এ সম্পর্কে তর্ক করছিল ইমাম রেজা (আ.) তাদের সমালোচনা করে বলেন: ইমামতের মর্যাদা এতটা উঁচুতে যে এই লোকগুলো তা উপলব্ধি করতে না পেরে এরকম ভ্রান্ত আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে।  এরপর ইমাম বলেন, মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে নবুওয়াত দান করার পর তাঁকে ইমামত দান করেছিলেন। এ অবস্থায় আল্লাহর এ নবী প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহ আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও কি ইমাম বানানো হবে? তখন আসমান থেকে গায়েবি আওয়াজ এসেছিল: আমার প্রতিশ্রুতি জালিম বা অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।  পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

এরপর ইমাম রেজা (আ.) আরো বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ জালেম ও অত্যাচারী ব্যক্তিদের জন্য ইমামত নিষিদ্ধ করে তাঁর বাছাই করা বান্দাদের জন্য এটি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এরপর ইমাম সূরা আলে ইমরানের ৬৮ নম্বর আয়াতের কথা স্মরণ করেন যেখানে বলা হয়েছে: মানুষদের মধ্যে যারা ইব্রাহীমকে অনুসরণ করেছিল, তারা, আর এই নবী এবং যারা এ নবীর প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠতম।  আর আল্লাহ হচ্ছেন মুমিনদের ওলি ও অভিভাবক।

এই আয়াত তেলাওয়াত করার পর ইমাম রেজা (আ.) বলেন: রাসূলে খোদা (সা.) আল্লাহর নির্দেশে আলী (আ.)কে ইমাম নিযুক্ত করেন এবং বলেন, ইমামতের এই আধ্যাত্মিক দায়িত্ব পরবর্তীতে আলীর বংশধররা পালন করবে। রাসূলের এই নির্দেশ অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত ইমামতের দায়িত্ব হযরত আলী (আ.)’র বংশধরদের মধ্যে জারি থাকবে।

ইমাম রেজা (আ.) এরপর মার্ভের মসজিদে ইমামত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেন, তাহলে এই অজ্ঞ লোকেরা কীভাবে নিজেদের জন্য ইমাম নির্বাচন করছে? সত্যিকার অর্থে ইমামত হচ্ছে রাসূলের উত্তরসূরিদের পদমর্যাদা। ইমামতের ছায়াতলে ইসলামি সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হলেই নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব ও জিহাদ অর্থবোধক ইবাদতে পরিণত হয়। ইমামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একজন বিজ্ঞ আলেম ও পণ্ডিত হওয়া। তাঁর জ্ঞান বা ইলম আল্লাহ প্রদত্ত বলে তার জ্ঞানের সঙ্গে অন্য কোনো মানুষের জ্ঞানের তুলনা চলে না। ইমামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে কাফের ও মুনাফিকরা যারা সারাক্ষণ দ্বীন ইসলামের ক্ষতি করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে তাদেরকে ধ্বংস করা।

ইমাম রেজা (আ.) আরো বলেন, ইমামগণ ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। তারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবেন। মুসলিম সমাজে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

ইমাম এ বক্তব্যের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের ওপর চেপে বসা দখলদার শক্তিগুলোকে বিশেষ করে তৎকালীন শাসক মামুন আব্বাসির শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেন রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সমাজে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করা যেহেতু অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তাই কোনো জালেম ব্যক্তির পক্ষে এই পদে অধিষ্টিত থাকা শোভা পায় না। নিজে জালেম হয়ে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

তো বন্ধুরা! হাতে আজ আর সময় নেই।  আমরা গত আসরে ইমাম রেজা (আ.)’র শাহাদাতের ঘটনা বর্ণনা করেছি। ইমামকে এমনভাবে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয় যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে মুসলমানদের এই মহান নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি শাহাদাতের পর অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ইমামকে দাফন করা হয়। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ