নভেম্বর ০৯, ২০১৯ ১৯:০৩ Asia/Dhaka

ইমাম হাদি (আ.) ২১২ হিজরির ১৫ জিলহজ্ব পবিত্র নবী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম জাওয়াদ (আ.) এবং তাঁর মাতাও ছিলেন একজন ঈমানদার, মুত্তাকি ও মহিয়সী নারী।

ঈমানদার, সৎ ও আদর্শবান অভিভাবক একটি সন্তানের উত্তমরূপে বেড়ে ওঠা ও মহান নৈতিক গুণাবলী অর্জনের জন্য সহায়ক। যেকোনো মুমিন মুসলমান এরকম একটি পরিবারের সদস্য হতে পেরে গর্ববোধ করেন। আল্লাহ তায়ালা এমন পরিবার গঠনের জন্য বান্দাদেরকে তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াতে এ সংক্রান্ত দোয়াও শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।  বলা হয়েছে, “হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা ও পথিকৃৎ করে দাও।”

ইমাম হাদি (আ.)’র উচ্চ মর্যাদার কথা শুধু শিয়া আলেম ও ইতিহাসবিদগণই বর্ণনা করেননি বরং প্রখ্যাত সুন্নি আলেমরাও এই মহান ইমামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।  ইমাম হাদি (আ.)’র উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে মক্কার অধিবাসী মালেকি মাজহাবের বিশিষ্ট ফকিহ নুরুদ্দিন ইবনে সাবাহ বলেন, মানুষ অর্জন করতে পারে এমন কোনো গুণ নেই যা আবুল হাসান আলী হাদির মধ্যে ছিল না। তিনি সব ধরনের ভুল-ত্রুটি ও দোষমুক্ত ছিলেন। ধীর-স্থির ও শান্ত স্বভাবের এই ঐশী মানবের সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না।

ইমাম হাদি (আ.)ও নিজ পিতার মতো মাত্র ৮ বছর বয়সে ইমামতের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু আগের আসরেও আমরা যেমনটি বলেছিলাম, স্বল্পজ্ঞান ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের পক্ষে একথা মেনে নেয়া কষ্টকর যে, ৮ বছরের এক বালক মুসলিম সমাজের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

এ ধরনের মানুষ বয়স দিয়ে মানুষের যোগ্যতা বিবেচনা করে; তাঁর খোদায়ী গুণাবলী দিয়ে নয়। অথচ আল্লাহর নবী হযরত ঈসা (আ.) মাত্র কয়েকদিন বয়সে কাফেরদের সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরে বলেছিলেন, “আমি আল্লাহর বান্দা এবং তিনি আমাকে রাসূল বানিয়েছেন।” এ ছাড়া, হযরত ইয়াহিয়া (আ.) শিশু বয়সে নবুওয়্যাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

ইমাম হাদি (আ.)’র ঘনিষ্ঠ অনুসারী মুসা ইবনে ইমরান নাখায়ি একদিন ইমামকে বলেন, হে রাসূলের সন্তান! ঐশী ইমামদের কবর জিয়ারত করার জন্য আপনি আমাকে কিছু দোয়া শিখিয়ে দিন।  ইমাম হাদি (আ.) তার এ দরখাস্ত কবুল করেন এবং তাকে ‘জিয়ারাতে জামিয়ায়ে কবিরা’ নামক দোয়া শিখিয়ে দেন। বিশাল এই দোয়ায় একদিকে যেমন মহান আল্লাহর কাছে দরখাস্ত পেশ করা হয়েছে, তেমনি এতে মহান ইমামদের মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে এবং পাশাপাশি ইমাম হাদি (আ.)’র পাণ্ডিত্য ফুটে উঠেছে। যেসব নিন্দুক অল্প বয়সে ইমামের নেতৃত্ব গ্রহণের সমালোচনায় মুখর ছিল এই দোয়া প্রকাশিত হওয়ার পর তাদের মুখে চুনকালি পড়ে। এছাড়া, এই বিশাল দোয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের মর্যাদা এতটা সুচারুভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, নবীবংশের ঘোরতর শত্রুদের পক্ষেও তা অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না।

বিশেষ করে তৎকালীন আব্বাসীয় স্বৈরশাসক মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদি (আ.)’র ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার জন্য যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছিল জিয়ারতে জামিয়া’র মাধ্যমে তা অনেকাংশে ভণ্ডুল হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইমাম বিরোধী সব প্রচারণার স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যায়। নবী বংশের প্রতি মুতাওয়াক্কিল নিজের আক্রোশ মেটানোর জন্য কয়েকবার কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)’র মাজার ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়। বাদশার নির্দেশে ইমামের মাজার ধ্বংস করে সেখানকার মাটি ওলটপালট করে দিয়ে পানি ঢেলে দেয়া হয় যাতে ইমামভক্তরা আর তাঁর মাজারকে কেন্দ্র করে সমবেত হতে না পারে।  কিন্তু মুতাওয়াক্কিলের সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ইমাম হোসেইন (আ.)’র মাজার আজো সগৌরবে টিকে আছে ইমামের স্মরণে তাঁর ভক্তদের সমাবেশস্থল হিসেবে।

মানবজাতির ইতিহাসে শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয় সেই সঙ্গে অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদের কোনো নেতা বা ধর্মীয় গুরুই মহান ইমামদের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নন। এ সম্পর্কে ইমাম হাদি (আ.) তার জিয়ারতে জামিয়ায়ে কবিরা দোয়ায় বলেন, “হে আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারীগণ! আপনাদের প্রতি সালাম। আপনারা নিজেদের জীবনে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি তাঁর আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কথা ও কাজে আপনাদের চেয়ে অগ্রগামী এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আপনাদের প্রতি আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক।

ইমাম হাদি (আ.) সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য করবে।” এই মহান ইমাম বলেন, “যারা আপনাদের আনুগত্য করল তারা যেন আল্লাহরই আনুগত্য করল এবং যারা আপনাদের নির্দেশ অমান্য করল তারা তো আল্লাহর নির্দেশই লঙ্ঘন করল। আর যারা আপনাদেরকে ভালোবাসল তারা তো আল্লাহকেই ভালোবাসল এবং যারা আপনাদের সঙ্গে শত্রুতা করল তারা প্রকারান্তরে আল্লাহর সঙ্গেই শত্রুতা করল।  

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)’র পবিত্র আহলে বায়েতকে ভালোবাসার কথা খোদ কালামে পাকে উল্লেখ রয়েছে। সূরা শুরা’র ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, আপনি বলুন, আমি আমার রিসালাতের দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে আমার ঘনিষ্ঠজনদের প্রতি সৌহার্দ ছাড়া আর কিছু চাই না।” এই আয়াতের মর্মার্থ অনুযায়ী, আল্লাহর রাসূলের বংশধরদের ভালোবাসার সঙ্গে আল্লাহকে ভালোবাসার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যারা এর বিপরীত কিছু করবে অথবা রাসূলের বংশধরদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে তারা আল্লাহর নির্দেশ অস্বীকার করবে। এ ধরনের মানুষের ঈমানের দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত।

প্রকৃতপক্ষে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পরিবারকে ভালোবাসার কথাটি যতটা না রাসূল নিজে চেয়েছেন তার চেয়ে বেশি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাগিদ দেয়া হয়েছে।  সূরা শুরার এ আয়াত থেকে এ বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা এর আগে অন্য কোনো নবী বা রাসূলের বংশধরদের ব্যাপারে এমন কোনো নির্দেশে জারি করেননি।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ