ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (২ পর্ব): ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের কারণ
ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দাম কেন ইরানে হামলা চালিয়েছিল এক কথায় তার জবাব দেয়া মুশকিল। ওই হামলার আগে ও পরে সাদ্দাম দু’দেশের মধ্যকার সীমান্ত সমস্যাকে এ আগ্রাসনের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের ১৯ মাস পর চালানো এ আগ্রাসনের মূল কারণ ছিল সাদ্দামের ওই অজুহাতের চেয়ে ভিন্ন কিছু। গোটা পশ্চিমা ও আরব বিশ্ব ইরানের ইসলামি সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল এবং সাদ্দামের ইরান আগ্রাসনে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে মাত্র।
ওই আগ্রাসনকে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রথমেই দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সাদ্দাম যে অজুহাত দাঁড় করিয়েছিল সেদিকে নজর দেয়া যাক। ইরাক ও ইরানের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা শুরু হয় বহু বছর আগে ইরাকের ওপর ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের সময় থেকে। ওই সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়ার কারণে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক স্বাধীনতা অর্জনের পর আবার বিষয়টি আলোচনায় আসে। দু’দেশের মধ্যকার এই সীমান্ত সমস্যার মূলে ছিল সীমান্তবর্তী ‘আরভান্দ’ নদীর ভাগাভাগি। ইরাক এই নদীর পুরো মালিকানা দাবি করে আসছিল।
কিন্তু সে সময় ইরানের স্বৈরাচারী রেজা শাহ সরকার পশ্চিমা ব্লকে অবস্থান করছিল এবং আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন ভোগ করছিল। কাজেই ইরাক সরকার সে সময় ইরানের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করত না। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালে ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম হোসেন আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় ইরানের শাহ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যা ইতিহাসে ‘আলজিয়ার্স চুক্তি’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু সাদ্দাম এ চুক্তির ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিল এবং তা বাতিল করার জন্য উপযুক্ত সুযোগের সন্ধানে ছিল। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর সাদ্দাম সে মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে যায়।
ওই বছরের নভেম্বরে লেবাননে নিযুক্ত ইরাকের রাষ্ট্রদূত আন-নাহার পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইরানের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে আলজিয়ার্স চুক্তিকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, সম্পর্কের উন্নয়ন চাইলে ওই চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে। পরবর্তীতে ইরানে আগ্রাসন চালানোর পর সাদ্দাম এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আরভান্দ’ নদীর ওপর ইরাকের পূর্ণ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ইরানে হামলা চালিয়েছেন। ওই হামলার কয়েকদিন পর বাগদাদ সরকার এক বিবৃতিতে যুদ্ধ বন্ধের জন্য কিছু পূর্বশর্ত ঘোষণা করে এটা বোঝানোর চেষ্টা করে, ইরান ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং ইরাক আত্মরক্ষার্থে ইরানের ভূমিতে ঢুকে পড়েছে। ওই পূর্বশর্তগুলো ছিল, ইরাকের সার্বভৌমত্বের প্রতি ইরানের স্বীকৃতি, ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ, প্রতিবেশীসুলভ আচরণ বজায় রাখা এবং পারস্য উপসাগরের তিনটি দ্বীপকে তার আরব মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া।

সাদ্দাম এমন সময় তিনটি দ্বীপের ওপর আরবদের মালিকানার দাবি উত্থাপন করেন যখন ওই দ্বীপগুলো কয়েক হাজার বছর ধরে ইরানের মালিকানায় রয়েছে। অবশ্য ব্রিটিশ সেনারা কিছুদিনের জন্য এর দখল নিলেও তারা ১৯৭১ সালে পারস্য উপসাগর ত্যাগ করলে সেগুলো আবার ইরানের মালিকানায় ফিরে আসে। কিন্তু ওই বছর থেকে সংযুক্ত আরব আবিরাত ওই তিন দ্বীপের ওপর মালিকানা দাবি করে বসে। সাদ্দাম ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরব বিশ্বের পূর্ণ সমর্থন লাভ করার জন্য পারস্য উপসাগরের ওই তিন দ্বীপকে আরব আমিরাতের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার শর্ত জুড়ে দেন।
সাদ্দামের উচ্চাভিলাস শুধু ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সে চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান ক্রীড়নকে পরিণত হতে। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরাকের তৎকালীন শাহ সরকার ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অন্যতম প্রধান মিত্র। ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ সরকার উৎখাত হওয়ার পর সাদ্দামের মাথায় এই চিন্তা আসে যে, তার পক্ষে এখন ইরানের হারানো স্থানটি ফিরে পাওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কে মার্কিন ম্যাগাজিন নিউজউইক লিখেছে, ইরাকের তৎকালীন নেতৃত্ব গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। সে সময় ক্যাম্প ডেভিড আলোচনায় অংশ নেয়ার কারণে মিশর আরব বিশ্বে একঘরে হয়ে পড়েছিল। সিরিয়ায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল এবং ইরানে ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী নয়া সরকার ঘর গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের আসনটি শূন্য হয়ে পড়েছে বলে ইরাকের কাছে মনে হয়েছিল। সেই শূন্যতা পূরণের বাসনায় সাদ্দাম সরকার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র আমদানি করেন।
সাদ্দাম সরকার ইরানের নয়া ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর লক্ষ্যের কথাও প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন। তিনি ১৯৮০ সালের ১২ নভেম্বর এক সাক্ষাৎকারে বলেন: “ইরান খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ধ্বংস হয়ে গেলেও আমার কোনো অনুনশোচনা থাকবে না। আমি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছি, ইরান আমাদের শত্রু হওয়ায় ইরাকের যেকোনো নাগরিক এমনকি আরব দেশগুলোর যেকোনো নাগরিক ইরানের ধ্বংস কামনা করে।” ইরান আগ্রাসনের আট মাস পর তৎকালীন ইরাকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজ বলেন, “ইরাকের প্রতিবেশী হিসেবে একটি ইরানের অস্তিত্ব থাকার চেয়ে পাঁচটি ইরানের অস্তিত্ব থাকা আমাদের জন্য শ্রেয়তর।” তিনি এ ঘোষণার মাধ্যমে ইরানকে অন্তত পাঁচ ভাগে বিভক্ত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। ১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে গমনরত ইরাকি সেনাদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সাদ্দাম এ সম্পর্কে বলেন, “ইরানের আরব, কুর্দি ও বালুচসহ এ ধরনের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় আমরা সব ধরনের সহযোগিতা দেব। ইরানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। আমরা চাই সেদেশের প্রতিটি জাতি আলাদা জাতি-সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকুক।”#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।