নভেম্বর ৩০, ২০১৯ ১৯:৫৩ Asia/Dhaka

ইমাম হাদি (আ.) ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে শাসনক্ষমতায় মামুন ও তার ভাই মু’তাসিমকে দেখেছেন।

কাজেই তাদের কুচক্রী নীতির স্বরূপ ইমামের অজানা ছিল না। কিন্তু ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তাঁকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, কারণ এ সময়ে চারজন আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে ক্ষমতা হাতবদল হয়। এসব খলিফা তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য যেকোনো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাতেও দ্বিধা করেননি। আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে মুতাওয়াক্কিল ছিল নবী পরিবারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ পোষণকারী শাসক। গত আসরে আমরা যেমনটি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, এই মুতাওয়াক্কিলই হিজরি ২৩৬ সালে শহীদদের নেতা ইমাম হোসেইন (আ.)’র মাজার ভেঙে ফেলে ওই স্থানে কৃষিকাজ করার নির্দেশ দেয়। খলিফার অনুচর বাহিনী সে নির্দেশ বাস্তবায়নও করে। কিন্তু পরবর্তীতে ইমামের অনুসারীরা আবার তাদের প্রিয় ইমামের মাজার নতুন করে নির্মাণ করেন।

মুতাওয়াক্কিল আব্বাসি ব্যাপক দমন অভিযান চালানো সত্ত্বেও একথা উপলব্ধি করে যে, নবী বংশের ইমামদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা নস্যাত করার জন্য তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই একদিন সে তার দরবারের এক পারিষদকে প্রশ্ন করে, আমি এত চেষ্টা করেও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছি না অথচ রাসূলের বংশধররা কেন এত জনপ্রিয়? এ প্রশ্নের উত্তরে ওই পারিষদ ভয়ে ভয়ে জানায়, আহলে বাইত মানুষের অন্তরকে শাসন করে আর আপনি তাদের দেহের ওপর শাসন চালান। পবিত্র কুরআনের সূরা মারিয়ামের ৯৬ নম্বর আয়াতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ অতি সত্ত্বর মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন।”

শেষ পর্যন্ত ইমাম হাদি (আ.)’র প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্তব্ধ করে দিতে ব্যর্থ হয়ে মুতাওক্কিল ইমামকে নিজের রাজধানী শহর সামেরায় নিয়ে আসে। মুতাওয়াক্কিল নানা অজুহাতে ইমাম হাদি (আ.)’র ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালায়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত সুন্নি আলেম ইবনে জুযি লিখেছেন, একদিন মুতাওয়াক্কিল খবর পায়, ইমামের অনুসারীরা তার বাসভবনে চিঠিপত্র ও অস্ত্রসস্ত্র জমা করেছেন এবং তারা খলিফার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে চান। ইমামের বাসভবনে কি হয় তা জানার জন্য দীর্ঘদিন ধরে মুতাওয়াক্কিল সুযোগের সন্ধানে ছিল। এবার সে সুযোগ সে পেয়ে যায়।  সে তার নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে ইমামের বাসভবন থেকে সব কাগজপত্র রাজদরবারে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে নিরাপত্তা রক্ষীরা ইমামের ঘরে প্রবেশ করে কোনো কিছুরই সন্ধান পায়নি। তারা শুধু দেখতে পায় ইমাম ঘরের এক কোণে বসে একমনে কুরআনে তেলাওয়াত করছেন। তারা ইমামকে ওই অবস্থায় রাজদরবারে নিয়ে যায়। তারা খলিফাকে বলে, তার ঘরে অন্য জিনিস না পেয়ে ইমামকেই ধরে নিয়ে এসেছে।  

মুতাওয়াক্কিল ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায়। একদিকে সে ইমাম হাদি (আ.)’র ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে অসহায় মনে করে এবং অন্যদিকে ইমামের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যর্থতার লজ্জা ঢেকে রাখাও তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদি (আ.)কে নিজের পাশে বসায়। এক পর্যায়ে খলিফা নির্লজ্জভাবে ও ধৃষ্টতার সঙ্গে নিজের হাতে থাকা পানপাত্র ইমামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, হে আওলাদে রাসূল, শরাব পান করুন।  ইমাম হাদি (আ.) মুতাওয়াক্কিলের এই অবমাননাকর আচরণের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে শপথ করে বলেন, আমার রক্ত-মাংস কখনো এই নাপাক ও শয়তানি পানীয় গ্রহণ করবে না। এ অবস্থায় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকা মুতাওয়াক্কিল, ইমামকে একটি গল্প শোনাতে বলে। ইমাম হাদি (আ.) অনিচ্ছা সত্ত্বেও গল্প বলতে শুরু করেন:

ইমাম বলেন, রাজা-বাদশাহরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কত জৌলুসপূর্ণ জীবন যাপন করেন। কিন্তু তাদের পরাক্রম তাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। একদিন তাদেরকে এই বিশাল রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সাড়ে তিন হাত কবরে চলে যেতে হয়।  বসবাসের জন্য কবর কতই না মন্দ স্থান! কবরে গায়েবি আওয়াজ হয়, তোমার সেই মুকুট, সিংহাসন ও রেশমি পোশাক আজ কোথায়? দামী খাবার গ্রহণ করে যে সুন্দর চেহারা তৈরি করেছিলে তা আজ কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে তার পরিবর্তে কবর জবাব দেয়, সেই সুন্দর চেহারার ওপর এখন পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ বিচরণ করছে। সেই সুন্দর চেহারা খাওয়ার জন্য এখন পোকামাকড়েরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। দুনিয়াতে তারা দীর্ঘ সময় ধরে শুধু ভোগবিলাস আর পানাহারে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আজ তারাই কীটপতঙ্গের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।     

ইমামের গল্পে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নেশার ঘোর কেটে যায়, তার মুখমণ্ডল অশ্রুতে ভিজে যায় এবং সে শরাবের পাত্র ছুঁড়ে মারে। দরবারের বাকি লোকেরা উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে। তারা ভাবতেই পারেনি যে, ইমাম এতটা সাহসিকতার সঙ্গে মহাসত্য সম্পর্কে মুতাওয়াক্কিলকে উপদেশ দিতে পারবেন। খলিফা স্বাভাবিক হওয়ার পর ইমামকে সসম্মানে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়।

অবশেষে মুতাওয়াক্কিলের দুনিয়া থেকে বিদায় হওয়ার সময় এসে যায়। একদিন মুতাওয়াক্কিল ও তার উজির ফাতহ বিন খাকান যখন মদ খেয়ে বুদ হয়ে পড়েছিল তখন মুতাওয়াক্কিলের ছেলে মুনতাসির তার পিতা ও উজিরকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। মুনতাসির জনগণের ওপর তার পিতার অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে দেখেছিলেন বলে তিনি নিজে প্রশাসনের নীতিতে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেন। ইমাম হাদি (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করেন এবং জিয়ারতকারীদের জন্য ইমাম হোসেইন (আ.)’র মাজার উন্মুক্ত করে দেন। কিন্তু মুনতাসিরের শাসনামল দীর্ঘায়িত হয়নি। তিনি ছয় মাস রাজ্য চালানোর পর ২৪৮ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।

মুনতাসিরের মৃত্যুর পর একাধিক আব্বাসীয় শাসক ক্ষমতা গ্রহণ করে আবার ইমাম ও তাঁর অনুসারীদের ওপর দমন অভিযান শুরু করে এবং তাদের অনেককে শহীদ করে। ইমাম হাদি (আ.)’র জীবদ্দশায় সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফার নাম ছিল মুয়াত্তাজ। সে মুতাওয়াক্কিলের মতো ইমামের বিরুদ্ধে দমন অভিযানকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। অবশেষে মুয়াত্তাজের নির্দেশেই বর্তমান ইরাকের সামেরা শহরে ২৫৪ হিজরির ৩ রজব নিজ ঘরে গৃহবন্দি অবস্থায় ইমামকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ