ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯ ১৯:০৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, ইমাম হাসান আসকারি (আ.) আব্বাসীয় শাসকদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক চাপ ও দমনপীড়নের শিকার হয়েছিলেন।

কারণ, আব্বাসীয় শাসকরা একথা জানতে পেরেছিল যে, হযরত হাসান আসকারির ঘরে এমন এক সন্তানের জন্ম হবে যিনি আব্বাসীয় শাসকদের ক্ষমতার মসনদ উল্টে দেবেন। তিনি সারাবিশ্ব থেকে জুলুম-নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এ কারণে আব্বাসীয় শাসকরা ফেরাউনের মতো তাদের গোয়েন্দা বাহিনীকে এই নির্দেশ দিয়েছিল যে, ইমাম হাসান আসকারির স্ত্রীর মধ্যে গর্ভধারণের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে তাকে যেন পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং যখনই সে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে তখনই যেন নবজাতককে হত্যা করা হয়।

কিন্তু শাসকগোষ্ঠী একথা চিন্তা করে দেখেনি যে, মহান আল্লাহ তাদের এই ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেবেন। পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে: “এবং বাতিলের অনুসারীরা (সত্যকে পরাজিত করার জন্য) চক্রান্ত করেছে আর (এটা ভুলে গেছে যে) আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুত: আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী।” আব্বাসীয় শাসকদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে নবী বংশের সর্বশেষ ইমাম হযরত মাহদি (আ.) অবিশ্বাস্যভাবে ধুলির ধরায় আগমন করেন। ফেরাউন যেমন শত চেষ্টা করেও মূসা (আ.)’র জন্মগ্রহণের খবর জানতে পারেনি তেমনি আব্বাসীয় শাসকরাও ইমাম মাহদির জন্মের খবর জানতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এতটা গোপনীয়তায় ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’র সন্তানের জন্ম হয় যে, ইমামের ঘনিষ্ঠতম অনেক ব্যক্তিও তা জানতে পারেননি।

এদিকে ইমাম হাসান আসকারি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে একদিকে মানুষের সামনে খাঁটি মোহাম্মাদি ইসলাম তুলে ধরেন সেইসঙ্গে দুনিয়াপূজারি দরবারি আলেমদের পক্ষ থেকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়া ইসলাম পরিপন্থি বিষয়গুলির বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে ইমাম একথা প্রমাণ করেন যে, ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। নিজ সন্তান ইমাম মাহদি (আ.)’র অনুপস্থিতিতে ইমামের অনুসারীরা যাতে হতাশায় না ভোগেন সেজন্য জনমত গঠন করা ছিল ইমাম হাসান আসকারির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ইমাম মানুষের জীবনে দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি আলী বিন হোসেইন বিন কুমি নামের একজন অনুসারীকে চিঠি লিখে বলেন: আমি তোমাকে তাকওয়া অবলম্বন, নামাজ প্রতিষ্ঠা ও যাকাত আদায় করার উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, যে ব্যক্তি যাকাত দেয় না তার নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।

ইমাম হাসান আসকারি এ উপদেশ দেয়ার মাধ্যমে মূলত পবিত্র কুরআনের নির্দেশই বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন কারণ, এই মহাগ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা যেখানেই নামাজের আদেশ দিয়েছেন সেখানেই যাকাত আদায় বা দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখান থেকে ইমাম সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, যাকাত না দিলে বান্দার নামাজ কবুল হবে না। অন্য কথায়, নামাজ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক এবং যাকাত হচ্ছে তাঁর বান্দার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়। ওই ব্যক্তি প্রকৃত নামাজ আদায়কারী হতে পারবেন যিনি একহাত আল্লাহর দিকে তুলে ধরবেন এবং অন্য হাতে তাঁর বান্দাদের সাহায্য করবেন। ইমাম হাসান আসকারি (আ.) ওই চিঠিতে আরো লেখেন: আমি তোমাকে অন্যের অপরাধ ক্ষমা করা, দৃষ্টি সংযত রাখা, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, ভাইদের দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং মূর্খদের আচরণের সামনে ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দিচ্ছি।

ইমামের এই উপদেশবাণীগুলো যদি একটি সমাজের প্রতিটি মানুষ মেনে চলে তাহলে সে সমাজের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন শক্তিশালী হবে, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ কমে আসবে এবং সমাজ আন্তরিকতা ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে ভরে উঠবে।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) ওই চিঠিতে আরো লেখেন: তোমাকে মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করার, ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখার নির্দেশ দিচ্ছি। এরপর ইমাম পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১১৪ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে বলা হয়েছে, “তাদের অধিকাংশ সলা-পরামর্শ ভাল নয়; কিন্তু যে সলা-পরামর্শ দান খয়রাত করতে কিংবা সৎকাজ করতে বা মানুষের মধ্যে সন্ধিস্থাপন কল্পে করা হয় তা স্বতন্ত্র। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ কাজ করে আমি তাকে শিগগিরই বিরাট পুরস্কার দান করব। সবশেষে ইমাম তাঁর ওই অনুসারীকে সব ধরনের গুনাহমুক্ত জীবন যাপন করার নির্দেশ দেন।

মানুষকে সব খারাপ ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত করে তাকে পবিত্রতা ও উন্নত চরিত্রের দিকে ধাবিত করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে নামাজ। ইসলামে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পাশাপাশি শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নফল নামাজ আদায়ের ওপরও অনেক তাগিদ দেয়া হয়েছে। সব ধরনের কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে একান্তে আল্লাহর কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলার যে সহজাত চাহিদা মানুষের রয়েছে তা পূরণ হয় তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে। আরামের ঘুম হারাম করে আল্লাহর সঙ্গে একান্তে সম্পর্ক স্থাপনের স্বাদ যারা একবার উপভোগ করেছেন তারা কখনো এই নামাজ ত্যাগ করেন না। ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এ সম্পর্কে তার চিঠিতে বলেন, আমি তোমাকে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তুমি আমার এ আহ্বানের কথা আমার অনুসারী শিয়াদের কাছে পৌঁছে দেবে। 

নিঃসন্দেহে ইসলাম প্রচারের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে পবিত্র কুরআনের দিক-নির্দেশনা নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা।  গালভরা বুলি আওড়ানো এবং বক্তৃতা দেয়া বন্ধ করে আগে নিজের জীবনে ইসলাম বাস্তবায়ন করতে হবে। এ সম্পর্কে ইমাম আসকারি (আ.)’র গুরুত্বপূর্ণ উপদেশবাণী রয়েছে। তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে তাকওয়া ও পরহেজগারি অবলম্বনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বেশি বেশি চেষ্টা করার আহ্বান জানাচ্ছি। তোমরা কথা ও কাজে সত্যবাদী ও আমানতদার হবে।  নামাজে একনিষ্ঠতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে বেশি সময় সিজদায় পড়ে থাকবে এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে। আত্মীয়-স্বজনকে যথাসম্ভব সাহায্য করবে, কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে এবং তাদের কেউ মারা গেলে জানাযার নামাজে অংশ নেবে। সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণ রাখবে, বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করবে এবং বিশ্বনবী (সা.)’র শানে দরুদ পেশ করবে। কারণ, প্রত্যেকবার দরুদ পাঠ করলে ১০টি করে নেকি হাসিল হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ