প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা): পর্ব -১
'প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা)' শীর্ষক নতুন ধারাবাহিক আলোচনায় আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
মহানবী (সা) সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসুল। মহান আল্লাহর পর তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশ্বনবীর শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম। মহানবী (সা) মানব সভ্যতার সামনে সর্বোত্তম মানবীয় ও ধর্মীয় চরিত্রের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন এবং সমাজ ব্যবস্থার সব দিকের জন্যই দিয়ে গেছেন সর্বোত্তম আদর্শ। অথচ মানব-দরদী ও মুক্তিকামী এই শ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সংস্কারকের বিরুদ্ধে যুগে যুগে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ-মহলসহ সত্য-বিরোধী নানা মহল থেকে ছড়ানো হয়েছে অনেক অন্যায় অপবাদ ও কুৎসা!
পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা প্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছলে-বলে-কৌশলে কখনও তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচার এবং কখনওবা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য নানা বিষয়ে গবেষণায় মনোযোগী হয়েছিল। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের নানা জাতির ধর্ম, সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিন্তাধারা, ইতিহাস, অর্থনীতি ও বিশেষ করে মহানবী (সা)'র জীবনী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনও ছিল তাদের ওইসব গবেষণার অন্যতম প্রধান বিষয়।
নবী-রাসুলদের প্রচারিত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা হল প্রাচ্যের জাতিগুলোর ঐক্য ও সংহতির অন্যতম প্রধান বন্ধন। এ অঞ্চলের সভ্যতাগুলো আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে বস্তুগত সম্পদের চেয়ে বেশি জোর দেয় এবং এভাবেই জীবন অর্থপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করে।
পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা ইসলামকে বিশেষভাবে টার্গেট করেছে এবং এ ধর্মের গোড়া বা উৎসগুলো নিয়ে গবেষণার নামে ইসলামকে সব দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।
পাশ্চাত্য মুসলিম স্পেন তথা প্রাচীন আন্দালুসিয়ায় ইসলামের শক্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল এবং ইসলামের আবির্ভাবের সময় থেকেই বিশ্বাসী খ্রিস্টানরা ইসলামকে এক বিস্ময়কর ধর্ম ও কুপ্রথা বা বিচ্যুতি বলে ধরে নিয়েছে। পশ্চিমা খ্রিস্টান পণ্ডিতরা সেই প্রথম থেকেই ইসলাম ও এর মহানবীর (সা) বিপক্ষে যত বেশি সম্ভব মিথ্যা প্রচার করেছে এবং সবচেয়ে জঘন্য অপবাদগুলো প্রচার করেছে এই আসমানি মহামানব সম্পর্কে। ফরাসি দার্শনিক, লেখক ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদ ভলতেয়ারও নাটক রচনা করেছেন বিশ্বনবীর (সা) বিপক্ষে অন্ধ-বিদ্বেষ নিয়ে। অবশ্য ভলতেয়ার পরবর্তীকালে ইসলাম ও মহানবী সম্পর্কে তার ধারণায় পরিবর্তন এনেছিলেন। ইউরোপের বেশিরভাগ লেখকই মুহাম্মাদ (সা)-কে ত্রুটিযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ও নৈতিকতা-লঙ্ঘনকারী বলে অপবাদ দিয়েছেন।
পাশ্চাত্য ইসলামকে সর্বোচ্চ সম্মানের আসন থেকে নামিয়ে আনতে এবং মুসলিম সমাজ সম্পর্কে মন্দ ধারণা দিতে ব্যাপক মিথ্যাচার, সত্য-বিকৃতি ও তথ্য-গোপনের মত নানা ধ্বংসাত্মক পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। অবশ্য ইউরোপীয় গবেষকরা ইসলামের মহানবী (সা) সম্পর্কে একই ধরনের বক্তব্য রাখেননি। বেশিরভাগ প্রাচ্যবিদ প্রাচ্যের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে সব সময়ই অসঙ্গত বক্তব্য রেখেছেন। তাদের মতে প্রাচ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অপূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ।
পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা কখনও কখনও প্রাচ্য সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানগত গবেষণা চালালেও রাজনৈতিক কারণে এইসব গবেষণা প্রভাবিত বা বিকৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ মিসেস অ্যান ম্যারি শিমেল লিখেছেন:
যেসব ধর্মের পক্ষ থেকে ইসলাম সবচেয়ে বেশি ভুল বিবেচনার ও এর পরিণতিতে সবচেয়ে বেশি আঘাতের শিকার হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্ম। এ ধর্মের পণ্ডিতরা ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে অত্যন্ত বিকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। বিকৃতি এতটাই গভীর হয়েছে যে পাশ্চাত্যে কখনও কখনও মহানবীর নামকে অশুদ্ধ উচ্চারণে যেমন, 'মাহমেট' নামে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় যে তিনি ছিলেন এক ধরনের খোদা বা দেবতা!। তাঁর কথিত সোনালী ভাস্কর্য বা মূর্তিগুলোর প্রশংসার কথাও এসেছে তাদের লেখায়!
পশ্চিমা পণ্ডিতরা ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় ইসলাম এবং মহানবী সম্পর্কে অসত্য তথ্য প্রচার করেছেন। এর অন্যতম কারণ ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেননি তারা। অ্যান ম্যারি শিমেলের মত প্রাচ্যবিদদের মতে খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতকের প্রথম প্রায় দেড় দশকে এমন পশ্চিমা লেখকের লেখা খুব কমই দেখা গেছে যারা কুরআন ও আরবি ভাষা সম্পর্কে জানতেন। তাদের অল্প ক'জন আরবি ভাষা জানলেও কুরআনের শব্দ ও বাক্যগুলোর সঠিক অর্থ জানার চেষ্টা খুব কমই করেছেন!
১৮৪২ সনে গুস্তাভ উইল ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ ও ঘটনাগুলোর বাহ্যিক বিচারকে পৃথক করার ভিত্তিতে মহানবীর (সা) জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। এর পরের দশকগুলোতে উইলিয়াম মুইর, অ্যালয়স স্প্রেঙ্গার ও মার্গোলিয়োথের মত পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা মহানবী (সা) সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রচার করতে চাইতেন। আর এ জন্যই তারা মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলকে যথাসাধ্য সম্ভব বিকৃতভাবে তুলে ধরেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে কখনও কখনও ইতিবাচক মন্তব্য করতে চাইলে তাঁকে বড়জোর 'সামাজিক সংস্কারক' বলে উল্লেখ করেছেন!
কার্ল হাইনরিশ এমিল বেকার এক সময় লিখেছেন: মুহাম্মাদ (সা)'র ওপর কল্পিত কিছু চাপিয়ে দিতে আমরা অনেক কিছুই জানি, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে আমরা তেমন কিছুই জানি না!!
হেনরি ল্যামেন্স এমন একজন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ যিনি ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। কিন্তু তার লেখালেখি এতই অসঙ্গত যে এ সম্পর্কে অমুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে। আরব খ্রিস্টান লেখক জর্জ জোরদাক বেলজিয়ামের এই বিশপের বিদ্বেষপূর্ণ লেখালেখির বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, এ ধরনের লেখা বৈজ্ঞানিক পন্থা ও যৌক্তিক চেতনার বিরোধী।
সময়ের আবর্তনে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা যদিও ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে তাদের লেখায় কিছুটা নিরপেক্ষতা বা ন্যায়বিচারের রঙ আনতে পেরেছেন এবং নিরপেক্ষ গবেষণামুখি হয়েছেন কিন্তু মহানবী ও তাঁর শিক্ষাকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য পাশ্চাত্যে কখনও জোরালো ও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। এমনকি ইউরোপীয় রেনেসাঁর যুগেও সেখানকার পণ্ডিতরা মহানবী (সা) ও ইসলাম সম্পর্কে তাদের বিদ্বেষ দূর করতে পারেনি। তারা সে সময়ও ইসলাম ধর্মের বিস্তার নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল।
কিন্তু এতসব বিদ্বেষ সত্ত্বেও মানবাধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে মহানবীর চরিত্র এবং বাণীসহ তাঁর অতুলনীয় মহত্ত্বগুলোর প্রভাব হৃদয়গুলোকে ক্রমবর্ধমান হারে আকৃষ্ট করছিল। তাই প্রাচ্যবিদরাও মহানবীর (সা) অতুল মহত্ত্ব ও শিক্ষার ব্যাপক প্রভাবকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ মিসেস শিমেল লিখেছেন: ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা) হচ্ছেন সভার প্রদীপ। তিনি এমন এক আলো যা অন্ধকার দূর করে জগতকে করে আলোকিত যে জগতে সমাবেশ ঘটেছে শ্রোতাদের। তিনি এমন এক প্রদীপ যা মানুষের হৃদয়গুলোকে বিমুগ্ধ পতঙ্গের মত প্রদীপের চারদিকে জড়ো করে।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/২১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।