ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ ১৭:৪০ Asia/Dhaka

গত কয়েক আসরে আমরা বলেছি, যতদিন এই ইমাম মাহদি (আ.)’র আবির্ভাব না হচ্ছে ততদিন মুসলিম বিশ্বের দায়িত্ব হচ্ছে যোগ্য আলেমের নেতৃত্বে তাঁর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা।

শিয়া মাজহাবে এই মতাদর্শ অনুযায়ী ‘বেলায়েতে ফকিহ’ বা যোগ্য নেতৃত্বের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন একজন বিজ্ঞ আলেম বেলায়েতে ফকিহ’র গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করবেন যিনি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক দিক দিয়ে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।  প্রখ্যাত শিয়া আলেম শেখ মুফিদ বেলায়েতে ফকিহ’র প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব রাজা-বাদশাহদের কাছ থেকে গ্রহণ করে যোগ্য আলেমদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

পরবর্তী যুগে শেখ তুসি, ইবনে ইদরিস হালাবি, খাজা নাসিরউদ্দিন তুসি, মোহাক্কেক সানি এবং শেখ বাহায়ি’র মতো প্রখ্যাত শিয়া ফকিহগণ ‘বেলায়েতে ফকিহ’র শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু এসব চিন্তাবিদ এই শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মতবাদকে বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।  সমসাময়িক যুগে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ‘বেলায়েতে ফকিহ’ বা যোগ্য আলেমের শাসন সম্পর্কিত সেই কাঙ্ক্ষিত ফতোয়াকে বাস্তবরূপ দান করতে সক্ষম হন।  তিনি এ সম্পর্কে বলেন, ইমাম মাহদি (আ.)’র নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী যে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট ইসলামি শাসনব্যবস্থা হচ্ছে তার সূচনা।

অবশ্য মুসলিম আলেম ও চিন্তাবিদদের মধ্যে এই মতবাদ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো আলেম মনে করেন, ইমাম মাহদি (আ.)’র আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে কোনো ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন নেই। কেবলমাত্র এই মহান ইমামই ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা রাখেন।  পক্ষান্তরে অন্য আলেমগণ মনে করেন, ইমাম মাহদির সার্বজনীন ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা আসার আগে যদি মুসলমানরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী একই কাজের প্রচেষ্টা না চালায় অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা না দেয় তাহলে পৃথিবী জুলুম অত্যাচারে ভরে যাবে। কাফির, মুশরিক ও জালেমদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে তারা দুর্বল ও মজলুমের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। আর সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটি সর্বোত্তম উপায়ে তখনই করা সম্ভব যখন মুসলমানরা যোগ্য আলেমের নেতৃত্বে একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। ইরানের মুসলিম জাতি ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের দেশে সেরকমই একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।

পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় কাফির ও মুশরিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে হযরত নুহ, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালামের মতো নবীদের সংগ্রামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তবে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর যুগের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিলেন সেটির গুরুত্ব আজকের যুগে উপলব্ধি করা তুলনামূলক অনেক সহজ। এ সম্পর্কে সূরা মুমতাহিনার ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

“তোমাদের জন্যে ইব্রাহিম ও তাঁর সঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল: তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে।”

ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের এই নীতি- অবস্থান সকল যুগের সকল মুসলমানের জন্য আদর্শ। কিন্তু ইমাম মাহদি (আ.)’র অনুপস্থিতিতে এই কাজটি যার নেতৃত্বে হবে তিনিই হলেন বেলায়েতে ফকিহ।

বেলায়েতে ফকিহ’র শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজে ইসলামি শরিয়ত বাস্তবায়ন করা। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামের হুকুম-আহকামগুলো জাগতিক শাসনব্যবস্থার অধীনে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বিশ্বনবী (সা.) মদীনায় যে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেখানে ইসলামের সব আদেশনিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হতো এবং আজও প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে সেরকম একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কাজ করে। ইমাম মাহদি (আ.)’র আবির্ভাব মুসলমানদের সে স্বপ্ন এবং অপেক্ষার অবসান ঘটাবে ঠিকই কিন্তু তার আগে যে শাসনব্যবস্থা মুসলমানদেরকে ওই মহাবিপ্লবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটি হচ্ছে ‘বেলায়েতে ফকিহ’র শাসনব্যবস্থা।

 

অবশ্য বেলায়েতে ফকিহ’র শাসনব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা বিবেচনা করতে হবে। আর তা হলো, যেকোনো আলেম বা ফকিহ এই শাসনভার গ্রহণ করতে পারবেন না। এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বিশেষ কিছু শর্ত ও গুণাবলী প্রয়োজন। ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এই বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যে ফকিহ তার কুপ্রবৃত্তিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে, নিজের জীবনে ধর্মীয় বিধিবিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের তাকওয়া বা পরহেজগারি অবলম্বন করতে পারবেন তাকে অনুসরণ করা সাধারণ মুসলমানের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে। এখানে যে বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইমাম বেশি তাগিদ দিয়েছেন তা হচ্ছে কুপ্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

তো বন্ধুরা, আজকের এ আলোচনার মাধ্যমে আমরা শেষ করতে যাচ্ছি ঐশী দিশারী শীর্ষক ধারাবাহিকের সর্বশেষ পর্ব। এ আসরে আমরা রাসূলে খোদা (সা.)’র জীবনী থেকে শুরু করে মহান ইমামদের জীবনী সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। সবশেষে আমরা বলেছি, ইমাম মাহদি (আ.)’র আবির্ভাবের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সব ধরনের জুলুম অত্যাচারের অবসান ও সারাবিশ্বে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই শাসন দেখার প্রবল আকুতি ব্যক্ত করে আসর গুটিয়ে নিচ্ছি। আমাদেরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ। #

 

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ