জীবনশৈলী (পর্ব-১৭): সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক
প্রিয় বন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর উপায় নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান জীবনশৈলীতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা বলেছি আরও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে ব্যায়াম বা শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ ব্যায়াম মানুষকে সুস্থ ও সতেজ রাখে।
ব্যায়াম মানুষের শরীর পুনর্গঠনে বিশেষ অবদান রাখে। রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। যারা নিয়মিত, পরিমিত ব্যায়াম করেন তাদের অসুখ কম হয়। দেহ যেমন সুস্থ থাকে তেমনি মনও থাকে প্রশান্ত। এর মধ্যদিয়ে আমাদের জীবন হয়ে ওঠে আরও বেশি সুন্দর ও সুখময়। এ কারণে আমাদের সবার উচিত প্রতিদিন ব্যায়ামের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সময় বের করে নেয়া। মানুষের জীবনে আরও একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাহলো সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক।
জন্মের পর থেকেই মানুষ শেখে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে ও বেড়ে উঠতে তাকে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরাপদে থাকতে হবে। কোনোভাবেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এবং নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো অবকাশ মানুষের নেই। আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় আমরা সামাজিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যেই থাকি। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথোপকথনসহ নানা ধরনের যোগাযোগ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না তারা নিজেরা যেমন অন্যের কাছ থেকে উপকৃত হতে ব্যর্থ হয় তেমনি অন্যদেরকে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এ ধরণের ব্যক্তি ক্রমেই একা হয়ে পড়ে। আর এ কারণে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের যোগ্যতা থাকা জরুরি। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্ক রক্ষা করতে পারাটা এক ধরণের শিল্পই বটে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা মানুষের আত্মিক ও মানসিক চাহিদার অংশ। পারিবারিক পরিবেশে এর গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার হচ্ছে প্রথম সামাজিক সংগঠন। পরিবারেই শিশু ভূমিষ্ঠ হয় এবং ক্রমেই বেড়ে ওঠে। অন্য সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পরিবারের প্রভাবই শিশুর ওপর বেশি পড়ে। একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবার গঠনেও পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও জোরদারের কৌশল জানা জরুরি। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অপরকে বুঝতে পারা, পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখানো এবং সততার বিকল্প নেই। তবে পরিবারে সুস্থ ও সুন্দর সম্পর্কের জন্য কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলো হলো, বাবা-মায়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও সুসম্পর্ক। একজন শিশু যখন তার বাবা-মায়ের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক দেখে তখন সেও নিজের মধ্যে তা আয়ত্ত্ব করে। সন্তানদেরকে ভালো ও আদর্শ আচরণ শেখানোর ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মনোবিজ্ঞানী ও সুখী পরিবার বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক সুন্দর ও সুখময় জীবন গঠনে অপরিহার্য। পরিবারে যখন সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই তা পরিবারের সদস্যদের মন-মানসিকতা ও সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে এবং পারস্পরিক সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে সেসব পরিবার সব ক্ষেত্রে বেশি সফল। আসলে সুষ্ঠু-সুন্দর জীবন গঠনের প্রাথমিক ভিত্তিই হচ্ছে পরিবার। পরিবারেই শিশুরা পায় ভবিষ্যৎ জীবনের যাবতীয় দিকনির্দেশনা, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে করণীয়গুলো সম্পর্কে পরিবার-ই সঠিক শিক্ষা দেয়। এ কারণে পরিবারই মানুষের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে গণ্য হয়। সাধারণত পরিবারকে ঘিরেই আমাদের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা রচিত হয়।
পরিবারকে ঘিরে ব্যয় হয় মেধা-শ্রম-অধ্যবসায়। সমাজে চলাফেরা করতে গেলে আমাদের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে উঠাবসা করতে হয়। তাদের সাথে মনের ভাব আদান-প্রদানের জন্য আমাদের মধ্যে সামাজিকীকরণ শিক্ষা গড়ে উঠা খুব-ই প্রয়োজন। আর পরিবার আমাদের মাঝে সেই সামাজিকীকরণ শিক্ষা জাগিয়ে তুলতে পারে। ব্যক্তিত্ব বিকাশে কিংবা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের এই বাঁধন ভেঙে যায় নানাবিধ ঠুনকো কারণে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ায় পারিবারিক অস্থিরতা বাড়ে। সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতা লোপ পাওয়ায় এ ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। আর এই সমস্যা নিশ্চিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংক্রমিত হয়। পরিবার থেকে ছড়িয়ে পড়া এই সমস্যা গোটা মানবসমাজে প্রভাব ফেলে। আধুনিক যুগে অনেকেই নিজস্ব স্বার্থে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্লোগান বড় করে প্রচার করে। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন যদি পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে হয় এবং পরস্পরের সুখ-দুঃখ বুঝার মতো সচেতনতা জোরদার করা সম্ভব হয় তাহলে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা কখনোই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় বাধা সৃষ্টি করে না।
সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকেই পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, সুষ্ঠু-সুন্দর জীবন ও সমাজ গঠনের প্রাথমিক ভিত্তি পরিবার এখন ভাঙনের পথে এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আত্নিক মেলবন্ধন ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে বর্তমানে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অনেকেই পাশ্চাত্যের অনুকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে আমরা অনেকেই ভুলে যাচ্ছি আমাদের শেকড়কে, আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যকে। এই কঠিন জীবনপ্রবাহে পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে তাদের ভূমিকা আমরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি, অগ্রাহ্য করছি তাদের অস্তিত্বকে। সময়ের আবর্তনে পরিবারের সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা হয়ে উঠছে না। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের-ই সৌভাগ্য হচ্ছে না পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে বেড়ে উঠার। দিনে দিনে বিচ্ছেদের মাত্রাতিরিক্ত হার দেখে, পরিবারে ভাঙনের সুর বেজে উঠার সংকেত পেয়ে এখন সবার এটা উপলব্ধি করা উচিত যে, সুখ-শান্তির জন্য ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পরিবারের সবার মিলেমিশে থাকার কোনো বিকল্প নেই।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।