মেজর জেনারেল বাকেরি: মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে একজন দক্ষ সেনানায়ক
(last modified Sun, 08 Jun 2025 16:12:39 GMT )
জুন ০৮, ২০২৫ ২২:১২ Asia/Dhaka
  • মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি
    মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি

পার্স টুডে: ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি একজন শান্ত, মিতভাষী এবং সুদক্ষ কমান্ডার। তার কৌশলী ও সমন্বিত নেতৃত্ব তাঁকে ইরানের জনগণ ও সামরিক অভিজাতদের কাছে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাঁকে বলা হয় 'ইরানের সামরিক শক্তির আধুনিক স্থপতি'।

মেজর জেনারেল "মোহাম্মদ হোসেইন বাকেরি" ইরানি কমান্ডারদের একটি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন যারা কেবল ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান অবস্থানকে প্রভাবিত করেন না, বরং দেশের প্রতিরক্ষা মতবাদের ভবিষ্যত নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পার্স টুডে/র এই নিবন্ধে আমরা মেজর জেনারেল বাকেরির জীবনীটি একবার দেখে নেব।

জন্ম ও পরিচয়

১৯৬০ সালে তেহরানে জন্মগ্রহণকারী 'মোহাম্মদ হোসেইন আশফারদি' পরবর্তীতে মোহাম্মদ বাকেরি নামে পরিচিত হন। তিনি শহীদ কমান্ডার হাসান বাকেরির ভাই, যিনি ইরাকের বাথিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে ইরানের ৮ বছরের যুদ্ধের সময় একজন প্রতিভাবান কমান্ডার ছিলেন। বর্তমানে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই কমান্ডার শুধুমাত্র ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক ব্যক্তিত্বই নন, বরং ইরানের প্রতিরক্ষা কাঠামোর জন্য একজন দূরদর্শী স্থপতি। 

শিক্ষা ও একাডেমিক কার্যক্রম

মোহাম্মদ বাকেরি ইসলামি বিপ্লবের সময় উচ্চ বিদ্যালয়ের শেষ বছরে পড়াশোনা করছিলেন। বিপ্লবের পর তিনি প্রকৌশলের দিকে ঝুঁকেন এবং তৎকালীন পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (আমির কাবির) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কারণে কুর্দিস্তানে সংঘাত শুরু হলে, তিনি গ্রীষ্মকালে ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ড কর্পসে (আইআরজিসি) যোগ দেন। যুদ্ধের পর তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন এবং তেহরানের তারবিয়াত মোদারেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক ভূগোল ও ভূ-রাজনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইরানের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি এবং তারবিয়াত মোদারেস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন।

(বাম দিক থেকে প্রথম) মেজর জেনারেল বাকেরি এবং (বাম দিক থেকে তৃতীয়) শহীদ হাসান বাকেরি।

নাম পরিবর্তন

মোহাম্মদ বাকেরি তার ভাই হাসানের সম্মানে তার নাম পরিবর্তন করেন, যিনি যুদ্ধের সময় তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য 'হাসান বাকেরি' নাম নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, "আমার ভাইয়ের সম্মানে এই নাম আমার জন্য স্থায়ী হয়ে গেছে।" এই সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র তার শহীদ ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনই ছিল না, বরং এটি তার জন্য জিহাদ ও সেবার পথে একটি নতুন পরিচয় তৈরি করেছিল।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কমান্ড পর্যন্ত

২৩ বছর বয়সে, মোহাম্মদ বাকেরি আইআরজিসি'র ডিভিশনগুলোর গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত কারবালা ও খাতামুল-আম্বিয়া কমান্ড সেন্টারে অপারেশনাল ও গোয়েন্দা পরিকল্পনায় মূল ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের পর তিনি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফে যোগ দেন এবং গোয়েন্দা প্রধান, অপারেশন ও গোয়েন্দা উপপ্রধান এবং যৌথ স্টাফ প্রধান হিসেবে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

মেজর জেনারেল বাকেরি (ডান দিক থেকে প্রথম)

শত্রুর ভূখণ্ডে অভিযান

১৯৯৬ সালে, বাকেরি কোমালেহ ও ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে একটি সাহসী অভিযানের পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। জেনারেল আহমাদ কাজেমির নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানে ইরাকের ১০ কিলোমিটার গভীরে আক্রমণ করে এবং শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানে। এই অভিযানে বাকেরি আবারও তার কৌশলগত বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দেন।

জেনারেল পদে উন্নীত

৪৭ বছর বয়সে, বাকেরি খাতামুল-আম্বিয়া সেন্ট্রাল কমান্ডের ডেপুটি কোঅর্ডিনেটর নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর কাছ থেকে জেনারেল পদে উন্নীত হন, যা তার অসাধারণ যোগ্যতার স্বীকৃতি ছিল।

পবিত্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডারদের সাথে মেজর জেনারেল বাকেরি

সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফ কমান্ডার

২০১৬ সালের জুন, ৫৬ বছর বয়সে, জেনারেল বাকেরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার আদেশে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফ কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং জেনারেল সৈয়দ হাসান ফিরুজাবাদির স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি মাঠের অভিজ্ঞতা, একাডেমিক জ্ঞান ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফকে একটি গতিশীল কেন্দ্রে পরিণত করেন, যা সমন্বয়, ভবিষ্যৎ গবেষণা ও যৌথ সামরিক মহড়াকে শক্তিশালী করে।

সম্মাননা

জেনারেল বাকেরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কাছ থেকে দুইটি ফাতাহ পদক (তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণী) এবং একটি নাসর পদক লাভ করেছেন, যা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও ইরানের প্রতি তার নিঃস্বার্থ সেবার স্বীকৃতি।

জেনারেল বাকেরিকে পদক পরিয়ে দিচ্ছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা

নিষেধাজ্ঞা ও দৃঢ়তা

২০১৯ সালের নভেম্বরে, মার্কিন অর্থ বিভাগ তাকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীতে জড়িত ছিলেন। তবে, এই নিষেধাজ্ঞা তার সংকল্পকে দুর্বল করতে পারেনি, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তার দৃঢ়তাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

মেজর জেনারেল বাকেরি

চিন্তা ও লেখনী

বাকেরি একাডেমিক ক্ষেত্রেও উজ্জ্বল। ককেশাস, পশ্চিম এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীর সামুদ্রিক আন্তর্জাতিক আইন এবং ইরানের রাজনৈতিক ভূগোল ও ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতির প্রতি তার গভীর জ্ঞান ও প্রতিশ্রুতির পরিচয় দেয়। 

শহীদ সোলেইমানির পাশে মেজর জেনারেল বাকেরি

আধুনিক প্রতিরক্ষার স্থপতি

জেনারেল বাকেরি ইরানের সামরিক নীতিতে "প্রি-এম্পটিভ ডিফেন্স" ধারণার অন্যতম স্থপতি। তিনি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র, নৌ, বিমান প্রতিরক্ষা ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের ক্ষমতাকে দেশের প্রতিরোধের স্তম্ভে পরিণত করেছেন। তিনি আইআরজিসি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি গঠনমূলক সমন্বয় গড়ে তুলেছেন এবং পশ্চিম এশিয়ায় প্রতিরোধ অক্ষে একটি কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন।

একজন শান্ত ব্যক্তিত্ব, একজন গভীর চিন্তাবিদ কৌশলবিদ

জেনারেল বাকেরি শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিরক্ষা কূটনীতির ক্ষেত্রেও একজন সক্রিয় ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও আলোচনায়, তিনি সর্বদা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থানীয় সামরিক ক্ষমতা বিকাশের অধিকারের ওপর জোর দিয়েছেন এবং ইরানের প্রতিরক্ষা নীতির একটি ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তববাদী ও যৌক্তিক চিত্র উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তিনি একজন শান্ত, গম্ভীর ও স্বল্পভাষী কমান্ডার, যার পদ্ধতিগত ও ঐকমত্যভিত্তিক নেতৃত্বের শৈলী জনগণ ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আধুনিক সামরিক জ্ঞান, সম্মিলিত হুমকি বিশ্লেষণ ও জ্ঞানভিত্তিক যুদ্ধে তার দক্ষতার মাধ্যমে, তিনি ইরানের প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎকে শক্তিশালী করছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্টাফ কমান্ডার হিসেবে তার দায়িত্বের ১০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে, জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি ইরানের আধুনিক সামরিক শক্তির স্থপতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।#

পার্সটুডে/এমএআর/৮