জানুয়ারি ০১, ২০২০ ১৮:২৭ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা প্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য নানা বিষয়ে গবেষণায় মনোযোগী হয়েছিল।

এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের নানা জাতির ইতিহাস, অর্থনীতি ও বিশেষ করে  মহানবী (সা)'র জীবনী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনও ছিল তাদের ওইসব গবেষণার অন্যতম প্রধান বিষয়। পশ্চিমা খ্রিস্টান পণ্ডিতরা সেই প্রথম থেকেই ইসলাম ও এর মহানবীর (সা) বিপক্ষে যত বেশি সম্ভব মিথ্যা প্রচার করেছে এবং সবচেয়ে জঘন্য অপবাদগুলো প্রচার করেছে এই মহামানব সম্পর্কে।  সময়ের আবর্তনে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা যদিও ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে তাদের লেখায় কিছুটা নিরপেক্ষতা আনতে পেরেছেন এবং নিরপেক্ষ গবেষণামুখি হয়েছেন কিন্তু মহানবী ও তাঁর শিক্ষাকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য পাশ্চাত্যে কখনও জোরালো ও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। এমনকি ইউরোপীয় রেনেসাঁর যুগেও সেখানকার পণ্ডিতরা মহানবী ও ইসলাম সম্পর্কে তাদের বিদ্বেষ দূর করতে পারেনি।

 অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত প্রাচ্যবিদরা মহানবী (সা) ও ইসলাম সম্পর্কে যেসব গবেষণা করেছেন তাতে বাস্তবতা ও সত্যের ভাগ ছিল খুবই কম।  এ সময় পর্যন্ত ইসলাম ও মহানবীর প্রতি প্রাচ্যবিদদের হামলা অব্যাহত ছিল। তবে অতীতের সঙ্গে যেটুকু তফাৎ দেখা গেছে তা হল ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে তাদের নিন্দাবাদের লক্ষ্য বা মূল টার্গেট হয়ে ওঠেন স্বয়ং মহানবী (সা)।

পাশ্চাত্যের কথিত অ্যানলাইটেনমেন্ট যুগে বা আলোকায়নের যুগে যুক্তি ও প্রজ্ঞাকে গুরুত্ব দেয়া হলেও ইসলামকে ইউরোপে অযৌক্তিক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা হত। অবশ্য কখনও কখনও ইসলাম ধর্মকে আকর্ষণীয় ও শিহরণ-জাগানো বলে প্রশংসাও করা হত। কিন্তু সার্বিকভাবে ইসলামকে তখনও বিপজ্জনক ও মারাত্মক হুমকি বলে মনে করা হত। তবে এ যুগে অতীতের তুলনায় ইউরোপিয় ও পশ্চিমারা ইসলাম সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম খারাপ ধারণা পোষণ করত। এ যুগে পাশ্চাত্যে ইসলাম ও মহানবীকে (সা) সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রেরণাদায়ক উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে। কিন্তু এমনও ভাবার কারণ নেই যে এ যুগে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে পাশ্চাত্য নিরপেক্ষ হয়ে পড়েছিল কিংবা তারা কল্যাণকামী হয়ে পড়েছিল !

আসলে পাশ্চাত্যের কথিত আলোকায়নের যুগে তাদের প্রাচ্যবিদরা সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিল ইসলামের মহানবীর ওপর। এ যুগের খ্যাতনামা দুই ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ সাইমন অ্যাকলে ও জর্জ সিল (Simon Ackley, and George Seal ) মহানবী ও ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ চালিয়েছেন বলে দাবি করেন। আসলে আলোকায়নের তথা যুক্তি ও প্রজ্ঞার কিছু প্রভাব তাদের ওপর পড়লেও তারা পুরোপুরি বিদ্বেষমুক্ত ছিলেন না। সাইমন অ্যাকলে 'মুসলমানদের ইতিহাস' বা History of the Saracens শীর্ষক বই লিখেছেন। তিনি এ বইয়ে জনগণের সঙ্গে বিজয়ী মুসলমানদের আচরণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অন্যান্য বিজয়ী জাতির তুলনায় আরবরা বিজিত অঞ্চলের জাতিগুলোর সঙ্গে অনেক বেশি ন্যায়বিচারপূর্ণ, দয়ার্দ্র এবং সম্মানজনক আচরণ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

সাইমন অ্যাকলে  ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলীর (আ) বাণীর অনুবাদ সংক্রান্ত একটি বই প্রকাশ করেন। এ বইয়ে তিনি আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করেন। অ্যাকলে লিখেছেন: 'আমাদের তথা ইউরোপীয়দের মধ্যে যে সামান্য জ্ঞান আছে তা পুরোপুরি প্রাচ্য থেকে উৎসারিত। প্রাচ্যবাসীরা প্রথমে এই জ্ঞানকে গ্রিসে স্থানান্তর করে এবং রোমানরা তা থেকে কিছু অংশ ব্যবহার করে। এরপর বর্বরতা ও বন্যতা ছড়িয়ে পড়ে গোটা পশ্চিমা বিশ্বে। মুসলমানরা বিজয় অভিযানগুলো চালিয়ে আবারও ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ধারা চালু করেন। আর এইসব কিছুর জন্যই আমরা মুহাম্মাদের (সা) কাছে ঋণী।'  

জর্জ স্যাল পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করেছেন ইংরেজি ভাষায়। এর ভূমিকায় তিনি মহানবীর (সা) জীবন ও ইসলামী বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এরফলে তাকে পাশ্চাত্যে ব্যাপক প্রতিবাদের শিকার হতে হয়েছিল। পশ্চিমারাই তাকে আধা-মুসলমান বলে অভিযোগ তোলে। কিন্তু স্যাল অত্যন্ত কার্যকর ও সুচারুভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ওই ভূমিকাতেই লিখেছেন:

'মুহাম্মাদ ও কুরআন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি নিজেকে অবমাননাকর শিরোনাম, বর্ণনা এবং লজ্জাজনক ও অশোভনীয় ভাষা বা বাক্য ব্যবহারের অনুমতি দেইনি।... বরং মুহাম্মাদ ও কুরআন সম্পর্কে ভদ্রতাপূর্ণ, শিষ্টাচারযুক্ত ও শোভনীয় আচরণ করাটাকেই নিজের জন্য জরুরি বা অত্যাবশ্যক মনে করেছি।

জর্জ স্যাল-এর মতে মহানবী (সা) আরবদেরকে মূর্তি-পূজা থেকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং অন্যদের পক্ষ থেকে যেসব বিকৃতি একত্ববাদে অনুপ্রবেশ করেছে তা দূর করার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'আরব মুশরিকদেরকে প্রকৃত খোদার পরিচিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর তথা মুহাম্মাদ (সা)'র   পরিকল্পনা ছিল সুনিশ্চিতভাবে একটি সুশীল, খাঁটি ও প্রশংসনীয় পরিকল্পনা। এখানে আমি প্রয়াত লেখক পেরিডোর মত দাবি করতে পারি না যে মুহাম্মাদ নিজ জাতিকে মূর্তি-পূজার দিক থেকে এক খোদার ইবাদতের ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছেন এবং এ জন্য খারাপ ও অনুপযুক্ত কাজ করেছেন!'

খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকে বীরদের প্রতি শ্রদ্ধার চিন্তা-চেতনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। মহানবীকে (সা) জার্মান কবি গ্যাটে একজন মহান বীর হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। জার্মানির অন্যতম প্রধান ও সেরা কবি গ্যাটে যুবক বয়স থেকেই ছিলেন ইসলাম ও মহানবীর (সা) প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা বা গবেষণার উপকরণ তার কাছে খুব কমই ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মহানবী (সা) সম্পর্কে একটি কাব্য-নাট্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর সম্পর্কে  কেবল একটি প্রশংসা গীতি লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই গীতি-কবিতায় গ্যাটে মহানবীকে এমন এক বড় নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন যা বহু প্রস্রবণকে নিজের সঙ্গী করেছে এবং সব সময়ই যার শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব বাড়ছে; আর এর পাশাপাশি মহানবী নদীগুলোর রাখাল তথা মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে মানুষকে নিজের সঙ্গে চিরস্থায়ী আবাস বা সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এ অনন্য-রূপকধর্মী কবিতায় মহানবীর প্রিয়জন হযরত আলী (আ) ও প্রিয়তম কন্যা ফাতিমার কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপ ও উপমার মাধ্যমে বিশ্বনবীর এই অপরূপ চিত্র তুলে ধরেছেন জার্মান সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও দিকপাল গ্যাটে।

জার্মান কবি গ্যাটে মহানবী (সা)-কে অসাধারণ মানব বলে প্রশংসা করেছেন। তিনি পবিত্র কুরআনকেও চিরস্থায়ী সম্পদ বলে উল্লেখ করেছেন। #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।