জানুয়ারি ২৫, ২০২০ ২৩:৫১ Asia/Dhaka

জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার জবাবে ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সূচনামাত্র। আরও বড় প্রতিক্রিয়া হতে পারে। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন দৈনিক প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক ফারুক ওয়াসিফ।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

রেডিও তেহরান: জনাব ফারুক ওয়াসিফ, ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন যে, তারই নির্দেশে ইরানের জেনারেলকে হত্যা করা হয়েছে। ট্রাম্পের এই ভূমিকাকে অনেক বিশ্লেষক সন্ত্রাসবাদী ভূমিকা হিসেবে মন্তব্য করেছেন। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেয়

ফারুক ওয়াসিফ: দেখুন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকগুলো রীতি-নীতি লঙ্ঘন করেছেন। প্রথমত, ইরানের কদুস ফোর্সের প্রধান জেনারেল সোলাইমানি ডিপ্লমেটিক পাসপোর্টে ইরাকে গিয়েছিলেন। সেভাবে যদি নাও গিয়ে থাকেন-তিনি অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রীয় অতিথি। অন্য একটি রাষ্ট্রের অতিথিকে তিনি এভাবে হত্যা করতে পারেন না। আমি এরও আগের গোড়ার কথায় যেতে চাই।

সেটি হচ্ছে, ইরাকে কেন আমেরিকা?

আমরা ইরাকে গণহত্যা এবং বিপর্যয় এখনও দেখতে পাচ্ছি। এমনটি তো পৃথিবীর কারও কাছে কাঙ্খিত না। ফলে এটা আধিপত্য ছড়াতে চাওয়া একটি বড় রাষ্ট্রের সাথে একটা ছোটো রাষ্ট্রের যে স্বাধীনতার সমস্যা সেভাবেই বিষয়টিকে দেখা যায়। আর ট্রাম্প অন্য ছোটো রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আধিপত্যকামী নীতিতে বিশ্বাসী।

ইরানের মিসাইল হামলা

''ইরানের জবাব সূচনা মাত্র। আরও বড় প্রতিক্রিয়া হতে পারে।''

রেডিও তেহরান:  জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই যে আইন লংঘন করা- এজন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন? বিষয়টিতে ইরানের পক্ষ থেকে কী ধরনের ভূমিকা নেয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?

ফারুক ওয়াসিফ: দেখুন, এ বিষয়টি আসলে শুধু ইরানের নয়। তবে এখানে ইরানের অস্তিত্বে সংকটের প্রশ্ন। এর আগে আমেরিকা যেটি করত একটি তালিকা তৈরি করে তারপর হত্যাকাণ্ড চালাত। আর এখন টার্গেটেড কিলিং এর নামে এই কাজটি তারা যেকোনো দেশে করতে পারে। আর এটি বিশ্বের জন্য একটা ভয়াবহ আতঙ্কজনক অবস্থা।

এটা শুধু ইরাকে বলে কথা নয়। তারা সিরিয়াতে, আফগানিস্তানে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশেই তারা এধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। ফলে ওই দৃষ্টিতে জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়টি শুধু নিন্দা বা প্রতিবাদ নয়; এধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে আইনের আওতায় এনে যদি এর বিচার না করা যায় বা সেভাবে না দেখা যায় তাহলে যেকোনো রাষ্ট্র এমনকি খোদ আমেরিকাও একজন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনার কাছে বন্দি হয়ে থাকবে। ফলে যুদ্ধের বাইরে এ ধরনের যেকোনো হত্যাকাণ্ড নিন্দাযোগ্য। জেনারেল সোলাইমানি তো ইরাকে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন না। তাছাড়া ইরান বা আমেরিকা কেউই তো পরস্পর যুদ্ধ ঘোষণা করে নি। সে অবস্থায় তাঁকে হত্যার বিচার হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে।

ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

রেডিও তেহরান:  জেনারেল সোলাইমানি শহিদ হওয়ার পর ইরান আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছিল এবং পরবর্তীতে আমরা দেখলাম যে, ইরাকের দু'টি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ফারুক ওয়াসিফ: দেখুন, একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে বা বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যে বিষয়টি দেখছি সেটা হচ্ছে, গোটা বিশ্বের  শতবর্ষের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে যে সবসময় আমরা হুমকির মধ্যে থাকি।

ফলে এখানে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে-ইরাকে কেন আমেরিকা?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে- ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সমস্যাটা কী?

কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সমস্যাটা কী?

কিউবাতেও আমরা দেখেছি হামলার চেষ্টা হয়েছে। সেসময় সেখানে সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের ভূমিকার কারণে সেভাবে সফল হতে পারে নি। কিন্তু সেখানকার মানুষকে অর্থনৈতিক অবরোধসহ বিভিন্নভাবে আমেরিকা ভুগিয়েছে। সেখানকার নেতৃবৃন্দকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। একই জিনিষ আমরা ইরানের বেলাতেও দেখছি। আসলে এরমধ্যে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কোনো বিষয় নেই। পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক।

মার্কিন প্রেসেডিন্ট ট্রাম্প আধিপত্যকামী নীতিতে বিশ্বাসী

''ট্রাম্প  বিশ্বের অন্য ছোটো রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আধিপত্যকামী নীতিতে বিশ্বাসী।

''টার্গেটেড কিলিংএর নামে আমেরিকা বিশ্বে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।''

এখানে ইরাক একটি তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্র, বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এবং তার নিজের পথ চলার কারণে সে আক্রান্ত হচ্ছে আমেরিকার দ্বারা এবং অপর একটি দেশ ইরান। যে দেশটি নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখতে চায়। নিজের জনগণকে নিয়ে নিজেদের সমস্যা নিজেদের মতো করে সমাধান করতে চায়। এদুটি রাষ্ট্রসহ এ ধরনের অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য তো আমেরিকা হুমকি। পৃথবীর সব শান্তিপ্রিয় মানুষ আমেরিকার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছে। মানুষ সমালোচনা করছে এই জায়গা থেকে যে, ইরানের কোনো বিষয়ে বিচার করার দায়িত্ব তো আমেরিকার না। ইরান একটি স্বাধীন দেশ। সেদেশের সুন্দর জনগণ আছে। তারা আমেরিকার বিরোধীতা করেন এমনকি নিজ সরকারের অনেক কাজের সমালোচনাও করেন। ফলে এই দেশটির ওপর হস্তক্ষেপের অধিকার আমেরিকা কোথা থেকে পেল? এটি যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে আমাদের মতো দেশের সামনে এগোবার কোনো পথ নেই। আর সেই জায়গা থেকে আমরা এসব ঘটনার  প্রতিবাদ করি।

আর মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ইরান জবাব দিয়েছে। ইরানের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা এর আরও জবাব দেবে। আমার মনে হয় না ইরানের জবাব দেয়া এখানে শেষ হলো। ইরানের প্রতিক্রিয়া আমরা এখনও সেই অর্থে দেখি নি। এখন যেটা ইরান দেখিয়েছে সেটি সূচনা মাত্র। আরও বড় প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

কিন্তু আমরা যেটা বলতে চাই সেটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এখানে অনেকটাই নীরব। আমি গোড়ার দিকে যেটা বলছিলাম, যেকোনো দেশের সামরিক বা রাজনৈতিক নেতাদেরকে যুদ্ধের ময়দানের বাইরে যুদ্ধের নিয়ম ভেঙ্গে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করাকে যদি কেউ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং সেটাকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করতে পারে তাহলে পৃথবীতে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চলতে পারবে না। তখন পুরো পরিস্থিতিটাই যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে চলে যাবে।

ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

রেডিও তেহরান: অনেকে বলছেন, ইরানের পক্ষ থেকে যে হামলা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সেনারা প্রতিহত করতে পারে নি এবং এর মধ্যদিয়ে আমেরিকার সামরিক শক্তির দম্ভ অনেকটা চুরমার হয়েছে। তাদের সামরিক শক্তি অপরাজেয় সে দাবি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আপনার মূল্যায়ন কি?

ফারুক ওয়াসিফ: দেখুন, খুব সাধারণ দৃষ্টিতে এটা বুঝি যে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের  ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে তারা ঠেকাতে পারে নি বা তারা ধরতে পারে নি। এটা আমেরিকার দুর্বলতা এবং সেটা এক্সপোজ হয়ে গেল। একইভাবে ইরানের আকাশে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী যে বিমান বিধ্বস্ত হলো এবং ইরান স্বীকার করল যে এটা তাদের একটা ভুল। ফলে জটিল পরিস্থিতিতে বা উত্তেজনাময় মুহূর্তে কিভাবে ড্রিল করতে হবে সেদিক থেকেও ইরানের ব্যর্থতাটাও কিন্তু উন্মোচিত হলো। এখানেও কিন্তু অনেক মানুষ মারা গেল।

আর আপনার যে মূল প্রশ্ন-'অসম যুদ্ধ'। সে ব্যাপারে আমি বলব, আমরা দেখেছি পৃথিবীর কোথাও কোনো জনযুদ্ধে আমেরিকা বিজয়ী হয় নি। ভিয়েতনামে দেখেছি। কিউবার জনগণও প্রচণ্ডরকমের ঐক্যবদ্ধ থাকায় সেখানে আমেরিকা নখ বসাতে পারে নি। ইরানের বেলাও আমরা দেখেছি আমেরিকার প্রথম পরাজয় হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সে সময় আমেরিকাকে ইরান থেকে চলে যেতে হয়েছিল। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তারা বিষয়টি দেখছে। ফলে আজকে এসে শুধুমাত্র বিপুল সামরিক শক্তি থাকলেই যে একটা দেশ জিতে যাবে এটা কিন্তু আর আগের মতো বলা যাবে না। কারণ বৃহত্তর জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে, তাদেরকে ধ্বংস করে কোনো পরাশক্তি বেশিদিন টিকতে পারে না। এখানে তাদের একটাই করণীয় থাকবে পরমাণু বোমা মেরে পুরো অঞ্চলটিকে ধ্বংস করে দেয়া। তবে স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়ায় তাদের পক্ষে দীর্ঘকাল কোনো দেশকে আগ্রাসনের মধ্যে রাখা সম্ভব না।

আর সেটা ইরানের বেলাতেও দেখছি, ইরাকে, লেবাননে এমনকি সিরিয়াতেও দেখতে পাচ্ছি। মোট কথা মানুষই তার ভবিষ্যত ঠিক করবে। পুঁজি, ডলার বা কোনো একটা মিসাইল দিয়ে সেটা ঠিক হবে বা এসবের হুমকির মধ্য দিয়ে সেটা ঠিক হবে এমনটি মানুষের নিয়তি হতে পারে না। আমরা এই শতকে এমনটি দেখতে চাই না।

আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ইরাকি জনগণ

রেডিও তেহরান: ইরাক, ইরান ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশের জনগণের অভিমত হচ্ছে- মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনাদের বিদায় নিতে হবে। এজন্য ইরাকের জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। এরপরও কিন্তু মার্কিন সেনারা সেখানে রয়েছে। এই যে মার্কিন সেনারা অনেকটা জোর করে থাকছে এটা কী ইরাকের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন নয়?

ফারুক ওয়াসিফ: দেখুন, ইরাকের সংসদে তো সেই জায়গাটা তুলে ধরা হয়েছে। সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন শুধু ইরাকে নয়; কাতারে, সৌদি আরবে বা  যেদেশে মার্কিন সেনা আছে সেদেশেই কিছু না কিছু সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সামষ্টিক জায়গা থেকে আমেরিকার নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এ অঞ্চল থেকে তাদের সেনাদের পাততাড়ি গোটানো উচিত।

তাছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। কারণ তেলের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ, তেল পরিবহনের জন্য সমুদ্র পথে তাদের নিয়ন্ত্রণের কারণে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক সুবধিাটা আমেরিকা পায় তার ফলে আমাদের মতো গরীব দেশেরও কিন্তু অর্থনৈতিক খেসারত দিতে হচ্ছে।

''ইরানের ওপর হস্তক্ষেপের অধিকার আমেরিকা কোথা থেকে পেল? এটি যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে আমাদের মতো দেশের সামনে এগোবার কোনো পথ নেই।''

ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার সেনাবাহিনীর সরে যাওয়া তাদের নিজেদের জন্যও মঙ্গলজনক কারণ এতে তাদের বিপুল ব্যয় হচ্ছে। আর আমাদের মতো দেশসহ গোটা বিশ্বের জন্যও সেটি মঙ্গলজনক। পৃথিবী যখন নতুন শতকে প্রবেশ করতে চায় তখন মার্কিন সেনা ঘাঁটি গোটা দুনিয়াকে কারাগারের মতো বানিয়ে রাখা আসলে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৫

 

ট্যাগ