মার্চ ২৪, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি বাহ্যিকভাবে মানুষের মধ্যে যেমন নানা অমিল রয়েছে তেমনি চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। এ কারণে মানুষের একে অপরের মধ্যে মতভেদ হতেই পারে।

এ অবস্থায় অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি ও তা বজায় রাখার জন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো সহনশীলতা। সহনশীলতা মানে অন্যের চিন্তা-ভাবনা, রীতি-নীতি, চলাফেরা, ধারণা ও সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে শেখা। পৃথিবীতে কোনো একটা কাজ কিংবা কোনো একটা সমস্যার সামধান বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে এমনকি জীবন সম্পর্কেও মানুষের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্যের মতামতকে মর্যাদা দিতে পারা, সেটা শোনা এবং মেনে নিতে পারাই হলো সহনশীলতা। গত আসরের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা সহনশীলতা ও ধৈর্য্য নিয়ে আলোচনা করব।

জীবনকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে সহনশীলতা ও ধৈর্য্য অপরিহার্য। পারিবারিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। সাধারণত সহনশীলতার অভাবেই পরিবারে নানা সমস্যা দেখা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি হয়। সহনশীলতার অভাবে পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও ঝগড়া-বিবাদ বা হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে, সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সুস্থ পরিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহনশীলতার ঘাটতি দেখা দিলে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও বিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কারো সমস্যাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। যেসব পরিবারে সহনশীলতার চর্চা নেই সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা সহজেই ঘরের ভেতরের ও বাইরের জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। তারা নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়। তারা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে পড়ে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুব সমাজের আচার-আচরণে অস্থিরতা ও বেপরোয়াভাব দেখা যায়, তার মূলে রয়েছে পারিবারিক সংস্কৃতি। পরিবার থেকে তারা সহনশীলতার  উপযুক্ত শিক্ষা পায়নি।

পবিত্র ইসলাম ধর্ম ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়সহ সকল ক্ষেত্রে সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। ইসলাম ধর্ম পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যেমন স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, সন্তান ও ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্কের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের ও সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। এ কারণে রাজনৈতিক, আইনগত, সংস্কৃতিক, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের ক্ষেত্রে সহনশীলতার পথ অবলম্বন করা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। সহনশীলতা মানুষকে শেখায় কী করে অন্যের মতামত বা আচার-আচরণ সহজভাবে গ্রহণ করতে হয় বা সহ্য করতে হয় এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। সামাজিক জীবনে নানা কাজকর্মে বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতা আসতেই পারে, সে কাজটি যদি হয় মহৎ, তাহলে সব বাধা ডিঙিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতা সহকারে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কেউ যদি বাধা-বিপত্তির কারণে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে তাহলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।  

ইসলাম ধর্ম হচ্ছে শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। ইসলামের সুমহান শিক্ষা হচ্ছে, প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ক্ষমা করা এবং মানুষের প্রতি সহনশীল হওয়া। একথা ঠিক যে, সহনশীলতা হচ্ছে ইসলামের একটি মৌলিক নীতি। তবে ইসলাম ধর্ম অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরোধী। সহনশীলতার অর্থ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, সমাজের মানুষ সহনশীল হলে অপরাধের ঘটনাও কমবে। দুঃখজনকভাবে বর্তমানে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। সহনশীলতার অভাবে কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সহকর্মীদের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, প্রতিশোধ নেওয়ার মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। ‌আর কর্মক্ষেত্রের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক সুস্থ সম্পর্কের ওপর অশুভ প্রভাব ফেলছে। এক পর্যায়ে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইসলাম ধর্ম  সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করে না।

সব ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা। সহনশীলতা না থাকলে পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অনুভূতি কাজ করে না। কাউকে নিজের চোখে যখন সম্মানিত মনে হয় না এবং নিজের পথটিই সঠিক বলে বিবেচনা করে সব ধরনের কাজ করে যায় মানুষ, তখনই সমাজে বড় ধরণের সমস্যা দেখা দেয়।  বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। সমাজের কিছু কৃষ্টি আছে, প্রচলিত ব্যবস্থা আছে, মানিয়ে চলার জায়গা আছে, একসঙ্গে বসবাসের দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু আমরা যখন একাকী সব সিদ্ধান্ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই তখনই অসন্তোষ দেখা দেয়।

বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, খুবই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বড় ধরণের হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু একটু সহনশীল হলেই তা ঠেকানো যেতো।  

কখনো কখনো একটি বাসে দু’জন যাত্রী জানালার গ্লাস লাগানো নিয়ে ঝগড়ায় মেতে উঠছে, কে বাসে আগে উঠবে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে, সহনশীল হলে এসব তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কখনোই ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হবে না। একই পাড়ায় দু’জন প্রভাবশালী থাকলে তাদের মধ্যেও দেখা যায় বিরোধ। এগুলো হচ্ছে সহনশীলতার অভাবে। সহনশীলতার অভাবে কোনো কোনো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। যে রাজনীতি মানব কল্যাণে হওয়ার কথা তা শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য ক্ষতি ডেকে আনছে। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা পরস্পরের প্রতি সহনশীল হলেই কেবল তারা দেশের আপামর জনসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবে।

আমরা সবাই পরস্পরের প্রতি আরও বেশি সহনশীল হব এবং একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখব- এ প্রত্যাশায় শেষ করছি জীবনশৈলীর আজকের আসর।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৪

ট্যাগ