ইরানের পণ্যসামগ্রী : শোভাকর ফুল ও উদ্ভিদ
গত আসরে আমরা আলোচনা করেছিলাম ইরানে মেশিনে তৈরি কার্পেটের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি নিয়ে। ইরানি কার্পেটের গুণগত মান এবং উৎপাদনের দিক থেকেও ইরানের শীর্ষস্থানে অবস্থান প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম। মেশিনে তৈরি কার্পেটের রঙ, ডিজাইন এবং বুণনের ক্ষেত্রে ইরানি শিল্পী কলাকুশলিরা বেশ দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে।
তাদের এই সৃজনশীলতাই কার্পেট শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ বা যন্ত্রপাতি তথা প্রযুক্তি ও কারিগরি উন্নয়নেও পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বুণন শিল্পের মেশিনারিজ তৈরি করেন যারা তাঁরা মেশিনের সাহায্যে হাতে বোণা কার্পেটের মতো গুণমান রক্ষা করার উপযোগী যন্ত্রপাতিও তৈরি করতে মনোনিবেশ করেছেন। সুতরাং কার্পেট শিল্পে ইরান যে অতি দ্রুততার সঙ্গে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে-সে কথা বলারই অপেক্ষা রাখে না। কার্পেটের পর আমরা এবার যাবো শোভা বৃদ্ধি করে এমন বাহারি ফুল ও উদ্ভিদ নিয়ে। ইরানের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে এই ফুল ও উদ্ভিদের নার্সারি। অন্তত চার হাজার হেক্টর ভূমিজুড়ে এখন এই নার্সারি শোভা পাচ্ছে ইরানে। বিশ্বব্যাপী তাই ইরানের উদ্ভিদ ও ফুল চাষের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বেশ লাভজনক একটি ব্যবসা হলো নার্সারির ব্যবসা মানে ফুল ও উদ্ভিদের ব্যবসা। বিশেষ করে যেসব ফুল বা উদ্ভিদ বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট কিংবা মাঠ-ময়দান, পার্ক, বাগ-বাগিচা সাজানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাপী এই শিল্পে গত কয়েক দশক ধরে অর্থ লেনদেনের পরিমাণ ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। বাহারি ফুল ও উদ্ভিদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কেন্দ্র এআইপিএইচের পরিসংখ্যান অনুযায়ী খ্রিষ্টিয় ১৯৫০ এর দশকে বিশ্ব বাজারে শোভাকর ফুল ও উদ্ভিদের বাণিজ্যিক মূল্যের পরিমাণ ছিল তিন শ কোটি ডলার। ২০১০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশ হাজার কোটি ডলারে। বলা হয়ে থাকে যে বর্তমানে বিশ্ব বাজারে বাহারি ফুল ও উদ্ভিদ কেনা বেচার আর্থিক পরিমাণ পণর হাজার কোটি ডলার। এই শিল্পে আর্থিক মুনাফা বেশি হবার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য দেশ বাহারি ফুল ও উদ্ভিদের বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে।

বাহারি ফুল ও উদ্ভিদের বাণিজ্যিক চাষের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। বলা যায় খ্রিষ্টিয় আঠারো শতকের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল এ জাতীয় ফুল ও উদ্ভিদ চাষ। ওই সময় ব্রিটেনের মতো ইউরোপের বেশ কিছু দেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিচিত্র ফুল ও উদ্ভিদ নিয়ে এসে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ক বাগান এবং বিশাল গ্রিন হাউজ গড়ে তোলে। ওই গ্রিন হাউজেই প্রতিপালন করা হয় উদ্ভিদ ও ফুলগাছগুলোকে। পরবর্তীকালে এইসব গ্রিন হাউজ এবং উদ্ভিদ বাগিচাগুলোকে জনসাধারণসহ গবেষকদের পরিদর্শনের জন্য সুযোগ করে দেয়। যারাই এগুলো পরিদর্শন করেছে সবাই মোটামুটি আকৃষ্ট হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে এই শিল্পের প্রশংসা করেছে। ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী এই ফুল ও উদ্ভিদ চাষ বাণিজ্য ও শিল্পের কাঠামো লাভ করেছে। সেই যে শুরু হয়েছে আজ পর্যন্ত এই বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান রয়েছে।
এইসব গ্রিন হাউজ এবং উদ্ভিদ বাগিচাগুলো জনগণের জন্য দেখার সুযোগ থাকার কারণে কৌতূহলী দর্শকদের ভিড় লেগেই থাকতো স্থাপনাগুলোতে। আর যিনিই দেখেছেন তাদের অনেকেই বাহারি ফুল ও উদ্ভিদের বাণিজ্যিক চাষের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। সুতরাং অতি দ্রুতই গ্রিন হাউজ এবং উদ্ভিদ বাগিচা শিল্প বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বেশ দ্রুততার সঙ্গে। আজ সারা বিশ্বে এই শিল্প ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করেছে। ইরানে বাহারি ফুল ও উদ্ভিদ চাষের ইতিহাস অনেকটাই প্রাচীন বলা যেতে পারে। প্রাচীনকালের ইরানিরাও আজকের মতোই ছিল বেশ সৌখিন এবং প্রকৃতি প্রেমিক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলাসী মন তাদের আবহমান কালের। তারা সুন্দর সবুজ-শ্যামল পরিবেশের পরিকল্পনা করে সেখানে ফুল ও উদ্ভিদ লাগিয়ে চমৎকার এক নান্দনিক দৃশ্য গড়ে তুলতেন।
মজার একটা ব্যাপার কি জানেন, প্রাচীনকালের ইরানিরা নীল পদ্মকে পবিত্র ফুল বলে মনে করতো এবং সেই থেকে প্রাচীন ইরানি সংস্কৃতির পবিত্র একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছিল এই নীলপদ্ম ফুল। শিরাজের বিখ্যাত পার্সপোলিস বা জামশিদ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ঐতিহাসিক নকশাগুলোতে এবং শুশের আপাদানা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের দেয়ালেও এই নীল পদ্মফুলের খোদাই করা নকশা দেখতে পাওয়া যায়। শুশের আপাদানা প্রাসাদ মানে হলো হাখামানেশিয় বাদশাহদের শীতকালীন প্রাসাদ। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে ইরানের সৌন্দর্য, চমৎকৃতি এবং প্রাচীন বাগ-বাগিচার খ্যাতি আজও অম্লান। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেই প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি ফুল এবং উদ্ভিদের প্রতিও রাজা-বাদশাহদের অনুরাগ ও আকর্ষণ ছিল লক্ষ্য করার মতো। তাদের প্রত্যেকটি প্রাসাদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল চমৎকার সব বাগ-বাগিচা।
কেবল যে স্থাপত্যশৈলীর প্রতিই তাদের মনোযোগ ছিল তা নয় বরং চিত্রকর্ম, ফাইন আর্টস, হস্তশিল্প ইত্যাদিরও সমাদর ছিল প্রাসাদবাসীদের কাছে। প্রাসাদগুলোতে লক্ষ্য করা যাবে ইরানিদের হাতে বোণা দারুন সব কার্পেটের সমাহার। এসব কার্পেটের ডিজাইনগুলোতেও ফুল এবং উদ্ভিদের জমকালো উপস্থিতি ছিল। কেবল রাজা-বাদশাই নয় প্রাচীন ইরানি কবি সাহিত্যিকদের মাঝেও ছিল ফুল এবং উদ্ভিদের প্রতি প্রবল অনুরাগ। কবিগণ বিভিন্ন ফুলকে বিভিন্ন প্রতীকে ব্যবহার করে অমর হয়ে আছেন বিশ্ব সাহিত্যে। লাল গোলাপ, জুঁই ফুল, নারগিস ফুল, শাকায়েক ফুল অ্যানিমোন করোনারিয়া, টিউলিপ ও গোলাপ ইত্যাদি ফুলের প্রতীকী ব্যবহার বেশ লক্ষনীয়। কোনো কোনোটি পবিত্রতা এবং নিষ্পাপ ঐশ্বর্য বোঝাতে, কোনোটিকে প্রাণ হারানো অর্থে, কোনোটিকে শাহাদাতের প্রতীকে আবার কোনো কোনো ফুলকে প্রেম-প্রীতি, বালোবাসা ও বন্ধুত্ব বোঝাতে ব্যবহার করেছেন কবিগণ। এসব প্রতীক পাঠক হৃদয়কে সহজেই মোহাবিষ্ট করে তোলে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২৬