জীবনশৈলী (পর্ব-৩২): মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলুন
গত আসরে আমরা বর্ণনা করেছি কীভাবে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)'র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) পরিচয় গোপন রেখে মানুষের সেবা করতেন।
আমরা এও বলেছি, ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে যেগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তিরা অন্যের উপকার করার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিলেন এবং তারা উপকার করার পর খোঁটা দেওয়াতো দূরের কথা বরং তা গোপন করার চেষ্টা করতেন।
কোনো ধরণের অর্থ খরচ ছাড়াই কীভাবে পরোপকার করা যায় তার কিছু উদাহরণ আজকের আসরের শুরুতেই তুলে ধরছি। মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলুন। কেউ কোনো কাজের জন্য আপনার কাছে এলে আপনি যদি তার কাজটি করে দিতে নাও পারেন হাসিমুখে ভদ্রভাবে তা বুঝিয়ে বলুন। তাতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। মানুষকে ভালো কাজের জন্য উৎসাহ দিন। অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করুন, যার প্রশংসা করলেন সে আরও ভালো কাজ করার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হোন। শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী খারাপ কাজ ঠেকানোর চেষ্টা করুন। কোনো ব্যক্তি কোনো খারাপ কাজ করলে তাকে বাহবা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কেউ যদি আপনার শত্রুর ক্ষতি করতেও খারাপ কাজ করে তাহলেও সেই খারাপ কাজের নিন্দা জানান। পথহারা বা ভুল পথে চলা মানুষকে সঠিক পথ দেখান। অসুস্থ মানুষকে দেখতে যান, তার সেবা করুন। নানাভাবে সান্ত্বনা দিন, বেঁচে থাকার আগ্রহ জাগিয়ে তুলুন।

তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি খাওয়ান। মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করুন। আপনার বাড়ি রাস্তার ধারে হলে অনেকেই হেটে আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে চলাচল করে, তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে পারেন, কেউ পানি চাইলে হাসি মুখে খুশি হয়ে তাদেরকে পানি দিতে পারেন। গাছ লাগাতে পারেন। গাছের যত্ম নিতে পারেন। কোনো ব্যক্তিকে যানবাহনে ওঠাতে বা মাল ওঠাতে সাহায্য করতে পারেন। সুন্দরভাবে কারো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পরোপকার করতে পারেন। সঠিক উত্তর জানা না থাকলে সুন্দরভাবে তা প্রশ্নকর্তাকে জানিয়ে দিন। মানুষের চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টিকারী কাঁটা, পাথর বা বাধা সরিয়ে ফেলুন। আপনার এলাকার ভাঙা রাস্তা ঠিক করে দিতে পারেন। সম্ভব হলে সাকু তৈরি করে দিন। এলাকার সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করুন। তবে এর কোনোটিই লোক দেখানোর জন্য হলে চলবে না। অনেক মানুষের একটি প্রধান ধ্বংসাত্মক আত্মিক রোগ হল লোক-দেখানোর প্রবণতা। এটা করা যাবে না।
পরোপকার যে পন্থায়ই করা হোক, আল্লাহ তাআলার কাছে তা কবুল হওয়া এবং একটি মর্যাদাপূর্ণ কাজরূপে গণ্য হওয়ার জন্য শর্ত হলো উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। পরোপকার করার পর সে বিষয়ে খোঁটা দেওয়া এই উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। যারা পরকালে বিশ্বাস করে না কেবল তারাই নগদপ্রাপ্তির আশা করে। এ ধরনের ব্যক্তিদের প্রত্যাশা হলো, যে ব্যক্তি উপকৃত হলো সে কোনো না কোনোভাবে তার উপকারের প্রতিদান দেবে অথবা অন্তত তার গুণগান করে বেড়াবে। কিন্তু যখন এর কোনোটাই পায় না, তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে এবং অকৃতজ্ঞ বলে গালাগাল করে। খোঁটা দেওয়া এক ধরণের অহমিকা। অহংকারী ব্যক্তিরা কারও উপকার করলে তাকে নিজের কৃপাধন্য বলে মনে করে। তাকে হীন ও ছোট ভাবে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম বারবারই বলেছে, কারো উপকার করলে অথবা কাউকে দান করলে ওই ব্যক্তির মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে করতে হবে। কোনোভাবেই যেন ব্যক্তির সম্মানহানি না হয়।
উপকার করা উচিত সেবা করার মানসিকতা নিয়ে। অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে। যিনি উপকার করছেন তার ভাবা উচিত এ কাজের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে লাভবান হচ্ছেন। উপকার করে প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেই উপকৃত হচ্ছেন। যিনি দান বা উপকার গ্রহণ করলেন সে তাকে আল্লাহর কাছে বিপুল মর্যাদা লাভের সুযোগ করে দিলেন। যে ব্যক্তি এ ধরণের ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে দান অথবা উপকার করেন তার পক্ষে খোঁটা দেওয়া সম্ভব নয়। সমাজে পার্থিব স্বার্থই সবচেয়ে প্রাধান্য পাওয়ায় পরোপকারের সংস্কৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পার্থিব স্বার্থ ভিত্তিক উপকারের প্রবণতার কারণে দরিদ্র ও অক্ষম মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে চান না অনেকেই। সবাই এমন কারো উপকার করতে চান যিনি প্রতিদান দিতে সক্ষম, বিপদের সময় এগিয়ে আসার সক্ষমতা রাখেন। এর ফলে দেখা যায়, একজন দরিদ্র মানুষ খুবই অল্প পরিমাণ অর্থ ধার চাইলেও তাকে দেওয়া হয় না। বেশিরভাগ মানুষই তেল মাথায় তেল দিতে অভ্যস্ত। এ কারণে সমাজের বিপদগ্রস্ত মানুষেরা আজীবন বিপদের মধ্যেই পড়ে থাকেন। তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার মতো মানুষ পাওয়া যায় না।
সমাজকে এই রোগ থেকে মুক্ত করতে হবে। অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করলে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়া যাবে তুলনামূলক অনেক বেশি। আসুন আমরা সবাই একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসি। যাদের প্রয়োজনীয়তা বেশি তাদের প্রতি বেশি লক্ষ্য রাখি, নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করি। সমাজের সব মানুষ দরিদ্র ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলে সমাজ থেকে অনেক সমস্যাই দূর হয়ে যেত এবং সবার জন্যই সুখ-শান্তি নিশ্চিত হতো।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।