সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২০ ১৬:৪৫ Asia/Dhaka

'পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা' শীর্ষক নতুন ধারাবাহিকের গত আসরে আমরা ভোগবাদ নিয়ে খানিকটা আলোচনার চেষ্টা করেছি। আমরা বলেছি, বর্তমানে ভোগবাদ হচ্ছে পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইলের একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এই ভোগবাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাকাকে গতিময় করেছে এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে।

ভোগবাদে মূলত: মানুষকে প্রতিনিয়ত পণ্য ও সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ভোগবাদ, পণ্যের উৎপাদনের প্রবণতাকে অতি উৎপাদনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে পণ্যের সরবরাহ ভোক্তার চাহিদার চেয়েও বেশি। এ কারণে পণ্য প্রস্ততকারকরা বিজ্ঞাপনসহ নানা কৌশলে মানুষকে নতুন পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মানুষ তার প্রয়োজনে নয় বরং সামাজিক মর্যাদা  বাড়াতে ও ক্ষণিকের সুখ পেতে পণ্য কিনছে বা সেবা নিচ্ছে। আজকের আসরে এ বিষয়ে আরও আলোচনা করব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন।  

গোটা বিশ্বেই ভোগবাদের প্রভাব বাড়ার ফলে পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। এ কারণে ওয়ালমার্টের মতো খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আয়ের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সারিতে স্থান করে নিতে পেরেছে। ২০১২ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোম্পানিগুলোর তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল ওয়ালমার্ট। রয়েল ডাচ শেল ও এক্সন মোবিলের পরেই ছিল এই খুচরা পণ্য বিক্রেতা ওয়ালমার্টের নাম। ২০১৩ অর্থবছরে এই কোম্পানির আয় ছিল ৪৬৯ বিলিয়ন ডলার। সে বছর এটি আয়ের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছিল। মানু্ষের ভোগ্যপণ্য সরবরাহের এই প্রতিষ্ঠানের বিশাল আয় এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেছনে ফেলার ঘটনা প্রমাণ করে ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার অকল্পনীয় মাত্রায় বাড়ছে। ভোগবাদে ব্যক্তি কখনো কখনো এমন সব পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তা অর্জন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে যা তার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু সে এমন সমাজে বাস করে যেখানে ওই পণ্য তার সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার পরিচায়ক।

ফরাসি তাত্ত্বিক জ্যাঁ বদ্রিয়ারের মতে, বিজ্ঞাপন আমাদের মধ্যে ভোগের সংস্কৃতি গড়ে তুলছে এবং ব্যক্তির পরিচিতি বিনির্মাণ করছে। ব্যক্তির পরিচিতির সঙ্গে পণ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ব্যক্তি ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে চায়। ভোগবাদী সমাজে একজন মানুষের পরিচিতি ও ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত হচ্ছে তার ভোগ্যপণ্যের ধরণের ভিত্তিতে। ব্যক্তি কী ধরণের ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করছে এবং ভোগ্যপণ্যটি কোন ব্র্যান্ডের তা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।  ভোগবাদী সমাজে মর্যাদা দেওয়া হয় ব্র্যান্ড ভোক্তাদের। মানুষের মর্যাদা নির্ধারণে ব্র্যান্ডের মূল্য আকাশচুম্বী। এ কারণে অনেকের মধ্যে ঋণ করে ভালো ব্র্যান্ডের ভোগ্যপণ্য কেনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঋণ করে অথবা বাকিতে পণ্য ক্রয়ের যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে তা কেড়ে নিচ্ছে মানুষের স্বস্তি। ভোগবাদের প্রভাবে সমাজে দুর্নীতিও বাড়ছে। ভোগবাদিতা চরিতার্থ করতে বনাঞ্চল ধ্বংস করে ক্রমাগত স্থাপন করা হচ্ছে কল-কারখানা। ইরানের সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোর্তজা কালিচ মনে করেন, যারা ভোগবাদে আকৃষ্ট এবং সামাজিক মর্যাদা ও পরিচিতির জন্য ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করেন তারা পুঁজিবাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট মারাত্মক প্রলোভন ও উসকানির শিকারে পরিণত হয়েছেন।   

ভোগবাদী সংস্কৃতি মানুষের মাঝে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা জোরদার করছে। কারণ ভোগবাদীরা নিজের চাওয়া-পাওয়া দিয়েই পৃথিবীকে বিচার করেন। পাশ্চাত্যে ভোগবাদী যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাতে মানুষের মনে এক ধরণের কৃত্রিম স্বাধীনতা ও মুক্তির অনুভূতি তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছে, ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার মধ্যেই রয়েছে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা এবং এখানেই কেবল একজন ব্যক্তি তার সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করতে সক্ষম। এই ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি অন্যের প্রতি কোন ধরনের দায়িত্ব অনুভব করে না। দায়িত্ব এড়িয়ে জীবন যাপন করতে পারাকে বড় ধরণের সাফল্য বলে মনে করে। এর ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ে তারা কষ্ট পান না এবং পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাপারে তারা চিন্তিত হন না। বিখ্যাত গবেষক জিল্স লিপোভেত্‌সকি তার রচিত ' বিয়ন্ড দ্য কনজাম্পশন বাবল' বইয়ে লিখেছেন, দেখা যাচ্ছে এক পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আলাদা টিভি রয়েছে। প্রত্যেকে তার নিজের কক্ষে সেই টিভি বসিয়ে নিয়েছে। প্রত্যেকের গাড়ি আলাদা। মোবাইল ও ল্যাপটপসহ সব কিছুই আলাদা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের একজন সদস্য ‌আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করে। বেশি বেশি পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে সুখ খুঁজে বেড়ায়।

বৈষয়িক সম্পদের দিক থেকে অগ্রগামী দেশগুলোর মানুষের সুখের একটা মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ভোগ্যপণ্য ক্রয় ও ব্যবহারের সক্ষমতা। কিন্তু ভোগবাদী ব্যবস্থায় মানুষ কি সত্যিই প্রকৃত সুখী হতে পেরেছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ভোগবাদ মানুষের সুখ নিশ্চিত করতে পারেনি, মানুষ আগের চেয়ে বেশি সুখী হয়নি বরং মানুষের মাঝে অস্থিরতা বেড়েছে। ভোগবাদ ও পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত দেশগুলোর মানুষের মধ্যে অবিরাম নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা ক্লাব, সিনেমা ও পিকনিকসহ নানা ধরণের আধুনিক ব্যবস্থার মধ্যে ডুবে থেকে প্রকৃতপক্ষে নিজের সত্তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়। মানুষের মধ্যে এখন সব সময় কাজ করে, না-পাওয়ার আত্মগ্লানি। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থেকে সেই আত্মগ্লানি ভুলে থাকতে চায়।   মানুষ ভোগের পেছনে ছুটতে গিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, নিজেকে নিয়ে চিন্তার অবকাশটুকুও তার আর নেই। মানুষ এখন সময়ের ঘাটতি অনুভব করছে, এর কারণ হলো সে তার চাহিদার গণ্ডিকে এতটাই বিস্তৃত করে ফেলেছে যে এখন সে ওই বিস্তৃত গন্ডির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং নিজেকেই হারিয়ে ফেলছে।  

ভোগবাদ মানবজাতিকে আত্মবিধ্বংসী পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, সময়, বিশ্রাম, চিকিৎসাসহ সব কিছুরই একটি সীমা রয়েছে, কিন্তু ভোগের যে তাড়না তা সীমাহীন। ভোগের বাসনার শেষ নেই। ভোগের কারণে যে সুখানুভূতি সৃষ্টি হয়, তা ক্ষণিকের। আর মানুষ এই ক্ষণিকের সুখকে স্থায়ী সুখে পরিণত করার জন্য আরও বেশি ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করছে, অবিরাম ছুটে চলেছে। কিন্তু ভোগবাদে যে প্রকৃত সুখ নেই তা সে বুঝতে পারছে না। আসলে ভোগবাদে বিভোর কোনো ব্যক্তি কখনোই এই উপায়ে প্রকৃত ও টেকসই সুখ ও আনন্দ খুঁজে পাবে না, এটা তার মিথ্যা ছুটে-চলা।#

 

ট্যাগ