সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০ ২১:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের আরেকটি বিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক শহর কাশানে গিয়েছিলাম। ইস্ফাহান শহর থেকে দুই শ কিলোমিটার দূরত্বে কাশানের অবস্থান।

ইরানের কেন্দ্রিয় মরুভূমি এবং কারাকাস পর্বতের মাঝখানে পড়েছে কাশান শহরটি। এই শহরের আবহাওয়া গরম। মানবেতিহাসের একটি প্রাচীনতম বসতি গড়ে উঠেছিল এখানকার 'সিয়ালক'  টিলায়। নতুন নতুন যেসব নিদর্শন এখানে পাওয়া গেছে সেগুলো গবেষণা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই শহরটি পনেরো হাজার বছরের পুরোনো।                                 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কাশানের অচলাবস্থার যুগ ছিল ইয়েলখানদের যুগ অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দী। এ সময় চেঙ্গিজ খানের ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েছিল ইরান। ঐ হামলায় কাশান শহরটিরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে সাফাভি আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে কাশান শহরটি পুণরায় বেশ উন্নত হয়ে ওঠে। এ সময় কাশান খ্যাতির শিখরে পৌঁছে । এ সময় যেসব পর্যটক ইরান সফরে এসেছিলেন , তাঁদের প্রায় সকলেই কাশানের সৌন্দর্য ও উন্নয়নে মুগ্ধ হয়ে এই শহরটিকে ইস্ফাহানের পর দ্বিতীয় সৌন্দর্যতম ও সমৃদ্ধ শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে এখানকার শিল্প-কল-কারখানা আর সাফাভি আমলের বুনন ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যের কথা সকলেই স্মরণ করেছেন। এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলোও আপনাকে নিয়ে যাবে হাজার হাজার বছর পেছনে।

কাশানের কাশানের আ'গা বুযুর্গ মাদ্রাসা ও মসজিদের কথা বলেছিলাম। এই মসজিদটি কেবল ইসলামী ইরানের একটি চমৎকার মসজিদই নয়, বরং এটি ইরানের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকলারও এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই কমপ্লেক্সটি কাশানের আবহাওয়ার সাথে মিল রেখে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। অগা'বুযুর্গ মাদ্রাসা ও মসজিদ কাশানের অন্যান্য ভবনের মতোই খোলা আঙ্গিনা রেখে তৈরী করা হয়েছে।  প্রকৃতি আর সবুজ নিসর্গের অভাব অনেকটা পূরণ করেছে এই মসজিদ ও মাদ্রাসা কমপ্লেক্স। কারণ এর খোলা আঙিনার মাঝখানে সবুজ ঘাসের লন বা চত্বর সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এই চত্বরটির চিত্তাকর্ষক সৌন্দর্য সবাইকেই কাছে টানে।

দেড়শ বছর আগে এই মসজিদ ও মাদ্রাসা কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে । অথচ তখনকার দিনের স্থাপত্য হিসেবে আজকের বিবেচনায় বেশ আধুনিকই ছিল।

কমপ্লেক্স ভবনটি দুই তলা বিশিষ্ট। প্রতিটি তলাই আঙিনা থেকে দেখতে বেশ চমৎকার । কারণ এটি একদিকে যেমন খোলামেলা আর প্রশস্ত তেমনি এর এক্সটেরিয়র ডিজাইন বা বাহ্যিক সজ্জাকৌশলের সৌন্দর্যও এককথায় উপভোগ্য। মসজিদে ঢোকার পথেই পড়বে জাঁকজমকপূর্ণ কারুকার্যখচিত গম্বুজ। গম্বুজের দুই পাশে দুটি মিনার দেখার মতো। এছাড়া মূল মসজিদের উপরেও রয়েছে দুটি গম্বুজ । বড়ো গম্বুজটি আটটি কলামের উপরে নির্মিত হয়েছে। গম্বুজের ভেতরে দুই স্তরে ইরানের ঐতিহ্যবাহী টাইলসের কারুকাজ করা। ছোট গম্বুজটিও একই রীতিতে বানানো । গম্বুজের উপরে ইটের তৈরী আলো প্রবাহিকা- অর্থাৎ ভেতরে আলো ঢোকার জন্য রাখা খালি ঘুলঘুলি, দেয়ালের গায়ে কারুকার্য করা কোরানের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি, নক্সা করা প্লাস্টার, শাবেস্তান বা খোলা মেঝেয়, হুজরা ও আঙ্গিনার সৌন্দর্য, ঘড়ি ইত্যাদি খুব সহজেই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই মসজিদের মতোই কাশান মাদ্রাসাও এই শহরের ইতিহাসের বৃহৎ স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃত ।                 

মসজিদ এবং মাদ্রাসার পর এবার কাশানের একটি সুপরিচিত হস্তশিল্প নিয়ে কথা বলা যাক। হাতে বানানো গালিচা কাশানের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। নিঃসন্দেহে কার্পেট বোণা ইরানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। যুগ যুগ ধরে ইরানীদের মধ্যে এই কার্পেট বোণার একটা ধারা পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। কার্পেট শিল্পটি একদিকে যেমন রুচিবোধের পরিচায়ক অন্যদিকে শিল্পীদের সৃজনশীল প্রতিভা ও শিল্পবোধেরও প্রমাণবহ । ইরানী কার্পেটের দিকে একটু শিল্পিত দৃষ্টিতে তাকালেই মনে হবে যে এখানকার কার্পেট শিল্পীদের প্রতিভা কতো উচচাঙ্গের। এটা নিঃসন্দেহে ইরানের জন্যে গর্ব করার মতো একটা ব্যাপার। যাই হোক, ইরানের বিভিন্ন শহরের মতো কাশানেও কার্পেট তৈরীর ঐতিহ্যবাহী ধারাটি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে । কাশানের কার্পেট, বুনন প্রক্রিয়া এবং রঙের দিক থেকে স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

সাফাভী আমলে অর্থাৎ খ্রিস্টিয় ষোলো শতাব্দীতে কার্পেটের নক্সা বা ডিজাইনকারীরা সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এইসব ডিজাইন, মৌলিকত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বিচারে এতো বেশী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে যে ঐ সময়কাল থেকে কাশানে এবং তার আশেপাশের গ্রামে এইসব নক্সার কার্পেট তৈরীর একটা রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। বিখ্যাত পর্যটক মার্কুপুলু তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে কাশানের মখমলের পাড়ে জরীর কাজ এবং এই শহরের কার্পেটে চমৎকার কারুকাজের কথা লিখেছেন। পশ্চিমা একজন ইরান বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আবহাম পোপও তাঁর বইতে ইরানের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলেছেন-শ্রেষ্ঠতম রেশমি কার্পেট বোণার কথা বলতে গেলে অবশ্যই কাশানের কার্পেটের নামই অবলীলায় উচচারণ করতে হবে। খ্রিস্টিয় ষোলো শতাব্দীতে কাশানের কার্পেট ফ্যাক্টরীগুলো থেকে বড়ো বড়ো রেশমি কার্পেট ছাড়াও সাধারণ নকশি কার্পেটের একটা ধারা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্বের একজন বিখ্যাত কার্পেট বিশেষজ্ঞ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুইশত প্রাচীন কার্পেটের মধ্যে ইরানের সাতটি কার্পেটকে সর্বোত্তম কার্পেট হিসেবে নির্বাচন করেছেন। মজার ব্যাপার হলো এই সাতটি কার্পেটের মধ্যে চারটি কার্পেটই কাশানে তৈরী। এগুলোর মধ্যে আরদাবিলী কার্পেট হিসেবে পরিচিত একটি কার্পেট লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অলব্রাইট যাদুঘরে শোভা পাচেছ। আরদাবিলী কার্পেট নক্সা এবং বুননের দিক থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম কার্পেট। তবে তথ্যপঞ্জী ঘেঁটে এবং স্বাক্ষর-তারিখ হিসেব করে দেখা যাচেছ যে, ঐ কার্পেট শিল্পী আসলে কাশানেরই অধিবাসী। বর্তমানেও কাশানের হাতে বোণা কার্পেট ইরানের ভেতরে তো বটেই, ইরানের বাইরেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত।ইরান থেকে যেসব কার্পেট দেশের বাইরে রপ্তানী করা হয়, তার অধিকাংশই কাশানের। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা কাশান ঘুরে বেড়িয়েছি। এখানকার টীলাময় ফুলের বাগান, স্বচছ পানির ঝর্ণাপ্রবাহ, সর্বোপরি কাশানের অধিবাসীদের আতিথেয়তা সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকবে আশা করি।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ