অক্টোবর ০১, ২০২০ ১৫:৩০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসরে আমরা কাশানের শিল্প-কল-কারখানা আর সাফাভি আমলের বুনন ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যে নিয়ে কথা বলেছিলাম।

এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো আপনাকে নিশ্চয়ই নিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর পেছনে। কাশানের আ'গা বুযুর্গ মাদ্রাসা ও মসজিদের কথা বলেছিলাম। এই মসজিদটি কেবল ইসলামী ইরানের একটি চমৎকার মসজিদই নয়, বরং এটি ইরানের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকলারও এক ঐতিহাসিক নিদর্শন।

কাশানের ফুলের বাগান, স্বচ্ছ পানির ঝর্ণাপ্রবাহ, বিশেষ করে এখানকার গোলাপ জলের উৎসব সত্যিই স্মরণীয় একটি ঘটনা। কাব্যশিল্প ও সাহিত্যের সূতিকাগার কাশানের এই ফুল বাগান এবং গোলাবজল গ্রহণ ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী একটি বিষয়। মে মাসের শুরু থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়ে কাশান এবং এর আশপাশের শহর ও গ্রামগুলো যেন সাজে অপরূপ প্রাকৃতিক রূপে। সাদা, লাল আর গোলাপি রঙের গোলাপ ফুলের পাশাপাশি নানা প্রজাতির ফুল তৈরি করে নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানে পা ফেলতেই যেন চারদিক থেকে বাতাশে ভেসে আসে ম-ম সুমিষ্ট ঘ্রাণ। মুহূর্তেই জুড়িয়ে যায় মন। আমরা আজও এই কাশানেই ঘুরে বেড়াবো। আপনারা আমাদের সঙ্গেই আছেন যথারীতি এ প্রত্যাশা রইলো।

একটা বিষয় আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন তা হলো আমরা যে শহরেই যাই না কেন সেই শহরেই একটা প্রাচীন বাজারের অস্তিত্ব আমরা পেয়েছি। কাশানেও রয়েছে সেরকম একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। সেলজুকি শাসনামল থেকে আজ পর্যন্ত এই বাজার আপন অস্তিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। ইউরোপের বিখ্যাত যেসব পর্যটক ইরানের কাশান সফর করেছেন তারা তাদের নিজস্ব ভ্রমণ কাহিনীতে এই বাজার সম্পর্কে লিখতে ভোলেন নি। কাশানের এরকম একটি বাজার হলো আমিন-উদ-দৌলা। এই বাজারে রয়েছে সুদূর প্রান্ত থেকে আসা বাণিজ্য কাফেলার থাকা-খাওয়ার সকল বন্দোবস্ত। সরাইখানা, মসজিদ, পানির চৌবাচ্চাসহ বিভিন্ন বস্তুর জন্য নির্দিষ্ট গলি ক্রেতা সাধারণের কেনাকাটার জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। এইসব গলিতে হাঁটতে হাঁটতে আপনি পরিচিত হবেন কাশানের বিচিত্র পেশার সঙ্গে। এখানকার হস্তশিল্প সামগ্রীসহ স্থানীয় বিচিত্র মিষ্টির সঙ্গেও পরিচয় ঘটবে।

কাশানের আ'গা বুযুর্গ মাদ্রাসা ও মসজিদ

কাশানের বিশেষ উপহার সামগ্রী কেনাকাটা করতে ঘুরে বেড়াতে হবে না এদিক সেদিক। বগলাভা, কাশানি হালুয়া, সুহান, আর্দেশিরে, বিদমেশকি ইত্যাদির মতো বিচিত্র মিষ্টি যেমন সহজলভ্য এখানে তেমনি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতির ফল-ফুলের নির্যাসও পাওয়া যাবে সহজেই। গোলাপ, দারচিনি, পুদিনা ইত্যাদির নির্যাস আপনি পাবেন একেবারে হাতের নাগালে। এসবের বাইরেও যে বিষয়টির উল্লেখ অবশ্যম্ভাবী তা হলো কাশানের কার্পেট। কাশান ইরানের মধ্যে বিচিত্র কার্পেট উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। ইরানের কাশানি কার্পেটের খ্যাতি ও ঐতিহ্য এতোই প্রাচীন যে ইউনেস্কোর মতো বিশ্ব সংস্থা এখানকার কার্পেটকে নিজস্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করতে ভোলে নি। একটু বিরতিতে যাচ্ছি। ফিরছি শীঘ্রই।

এতোক্ষণ তো শহরের ভেতরের কথা বললাম। শহরেই বাইরে আশেপাশেই রয়েছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অরন, বিদগুল, কামসার, ফিন, মাশহাদে এরদেহাল, নুশাবাদ, নিয়সার ইত্যাদি এলাকা সারা বছর জুড়ে কাশানের সৌন্দর্য অপরিবর্তিত রাখতে সাহায্য করে। মরুচারীদের কাছেও তাই কাশান খুবই পছন্দের একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিগণিত। প্রতিবছর মে'র শুরু থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়টায় মধ্য ইরানের কাশান শহরের পার্শ্ববর্তী কামসার এলাকায় গোলাপ ফুল থেকে গোলাপজল প্রস্তুতির কার্যক্রম শুরু হয়। বসন্তকালীন গোলাপজল প্রস্তুতকরণের এই উৎসব ইরানিদের কাছে ‘গোলাব-গিরি’ নামে পরিচিত। গোলাপজল উৎসবকে ঘিরে এ সময়টায় মধ্য ইরানে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

আকাশ-বাতাশে ছড়িয়ে থাকা গোলাপের সুবাস মানুষের মন জুড়িয়ে দেয়। ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে, সুমিষ্ট ঘ্রাণ নিতে আশপাশের লোকজন তো ছুটে আসেই। দৃষ্টিনন্দন উৎসবের আকর্ষণে কামসারসহ কাশানের আশপাশের শহর ও গ্রামগুলোতে ছুটে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। ফুল বাগানের সৌন্দর্য আর সুমিষ্ট ঘ্রাণে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন দর্শনার্থীরা।  মূলত বাসা-বাড়িতে কিংবা বাগানে কিভাবে গোলাপের কুড়ি থেকে গোলাপজল বানানো হয় তা দেখতেই ছুটে আসেন উৎসুক জনতা। আর এ থেকেই কাশানের কামসার, নিয়াসার ও বারজাক পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়েছে। বাতাসে ভেসে থাকা গোলাপের সুবাস মন মাতিয়ে তোলে। আবারও একটু বিরতি নিচ্ছি শ্রোতাবন্ধুরা! সঙ্গেই থাকুন।

ইতিহাস বলে, ইরানে তৈরি গোলাপ জল আড়াই হাজার বছর আগে থেকেই দুনিয়াখ্যাত। ‘গোলাব’ বা গোলাপজল হলো গোলাপের সুগন্ধি নির্যাস। যা বিভিন্ন ঐতিহ্যগত খাবারের সুঘ্রাণের জন্য দেশব্যাপী ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুগন্ধি হিসেবেও এটা ক্রয় করা হয়। গোলাপকে তাপ দিয়ে এর নির্যাস তৈরি করার প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানী ইবনে সিনার আবিষ্কৃত বলে মানা হয়। কারখানায় আনার পর পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দস্তার পাত্রে তাপ দেয়া হয় ফুলের পাপড়ি ও কুঁড়িকে। এর থেকে যে নির্যাস বের হয় তা দিয়েই তৈরি হয় উন্নতমানের গোলাপ জল। অনেকে মনে করেন, ফ্যাক্টরিতে গোলাপ জল উৎপাদনের চেয়ে ঐতিহ্যগতভাবে বাসাবাড়ি ও বাগানে যেভাবে গোলাপজল প্রস্তুত করা হয় তার মান অনেক ভালো। কেননা, ঐহিত্যবাহী এ পদ্ধতিতে গোলাপ ফুল সংগ্রহ ও তা থেকে গোলাপজল প্রস্তুতকরণের মাঝে খুবই কম সময় ব্যয় হয়। ফলে গোলাপজলের মানও ভালো হয়।

গোলাপ বা গোলাবজল নিয়ে আর কথা নয়। এ দুটো আসলে উপভোগ্য বিষয়। সুযোগ পেলে সরেজমিনে দেখে আসাটাই হবে সবচে ভালো। তবে একটি তথ্য দিয়ে রাখছি। সেটা হলো: সম্প্রতি কাশান শহরের গভর্নর জানিয়েছেন, কাশানে বছরে ২ হাজার টন গোলাপ জল ও তেল উৎপাদন হয়। তা রফতানি করে আয় হয় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ গোলাপ জল ও তেল পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ইউরোপে রফতানি হয়। বলছিলাম গোলাবজলের এই কামসারের বাইরেও কাশানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপনা ও বাগিচা। এর নাম হলো বগে ফিন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ