অক্টোবর ০১, ২০২০ ১৯:১০ Asia/Dhaka

গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

গত পর্বে আমরা জেনেছি যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী মাওলানা রুমির বাবা বাহা ওয়ালাদ ছিলেন একাধারে আলেম, আরেফ বা আধ্যাত্মিক সুফি-সাধক, কবি ও বক্তা এবং ধর্ম প্রচারক। তিনি নানা অঞ্চল ও দূরদেশ ভ্রমণ করে ধর্ম প্রচার করতেন। কোনো কোনো লেখকের মতে বাহা ওয়ালাদ খাওয়ারেজমশাহের নির্যাতন ও অবিচারের কারণে এবং ইরানে তাতার বা মোঙ্গলদের হামলার খবর শুনে বালখ্‌ থেকে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। ধারণা করা হয় তিনি ৬১০ হিজরিতে তথা ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে ট্রান্স অক্সিয়ানা অঞ্চল বা বালখ্‌ থেকে হিজরত করেন। বাহাওয়ালাদ পরিবার-পরিজন ও একদল শিষ্য নিয়ে হজ পালনের উদ্দেশ্যে বালখ্ থেকে বের হন এবং বাগদাদের দিকে যেতে থাকেন ও এক পর্যায়ে খোরাসানে পৌঁছেন। কাফেলার লোকজন মোঙ্গল বা তাতারদের হামলা সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন।  নিশাপুর ছিল সে সময় খোরাসানের সবচেয়ে পশ্চিমের শহর। এখানে তাতার বা মোঙ্গলদের ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটেছিল। বাহা ওয়ালাদ হিজরতের সময় বালখে তাতার বা মোঙ্গলদের ভয়াবহ হামলা, ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা ও লুটপাটের খবর শোনেন। ফলে তিনি খুবই মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হন।

এর আগেও নিশাপুর বার বার শত্রুর হামলার শিকার হয়েছে। এ ছাড়াও এখানে ঘটেছে প্রলংকরী ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষ। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিশাপুরের মত একটি বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী শহরের আশপাশ দিয়ে দূরদেশে যাওয়ার সময় বাহা ওয়ালাদ এ শহরে একবারও ঢুকবেন না বা ঢু মারবেন না তা ছিল অসম্ভব ব্যাপার।  আর ইরান ও তার আশপাশের বহু শহর ও অঞ্চলে ছিল বাহা ওয়ালাদের জ্ঞান ও ধার্মিকতার ব্যাপক খ্যাতি। বাহা ওয়ালাদ সেই ভয়ানক দিনগুলোতেই নিশাপুরে আসলেন। দৌলত শাহ সমরকন্দির বর্ণনা অনুযায়ী খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব বাহা ওয়ালাদ ও তার পরিবার নিশাপুরে এসেছেন শুনে সে সময়কার প্রখ্যাত আরেফ ও কবি ফরিদউদ্দিন আত্তার নিশাপুরি নিজেই তার সঙ্গে দেখা করতে যান।  দুই প্রখ্যাত আরেফ ও সুফি সাধক এবং বয়োবৃদ্ধ আলেম কথা বলেন মহান আল্লাহর সঙ্গে আধ্যাত্মিক মিলন বা লিক্বায়ে আল্লাহ, আল্লাহর ঘর তথা কাবা ঘর জিয়ারতে আগ্রহ ও আল্লাহর ওলিদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহের মত নানা বিষয়ে। সুফিদের অবস্থা ও সানায়ীর মরমি কবিতা নিয়েও তারা মত-বিনিময় করেন।

বাহা ওয়ালাদ যখন নিশাপুরে ফরিদ উদ্দিন আত্তার নিশাপুরির সঙ্গে মত-বিনিময় করছিলেন তখন তাদের পাশে ছিলেন বাহা ওয়ালাদের সুযোগ্য সন্তান  ভবিষ্যতের মাওলানা রুমি তথা শিশু জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ রুমি। এ সময় আত্তার এই শিশুর ব্যাপারে ব্যাপক বিস্ময় ও আগ্রহ অনুভব করেন। এই শিশুর তথা শিশু রুমির আত্মিক অবস্থা, চিন্তাশীলতা ও চিন্তার গভীরতা এবং বর্ণনার শক্তি দেখে তিনি বিস্মিত হন। এই শিশু যে মামুলি ধর্ম-প্রচারক, সুফি ও ইসলামী আইনবিদদের গণ্ডীতে সীমিত থাকবেন না তা তিনি তখনই অনুভব করেন। তিনি বাহা ওয়ালাদের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এই শিশু নিঃসন্দেহে অসাধারণ মহামানব হবেন। আত্তার বলেন, এই শিশু একদিন খোদা প্রেমিকদের হৃদয়ে আগুন জ্বালাবেন এবং সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলবেন। আত্তার তার যৌবনে মাসনাভিয়ে আসরারনামেহ বা রহস্যরাজির দ্বিপদী কাব্য নামের যে কাব্য লিখেছিলেন তার একটি কপি খোদায়ি শিশু জালালউদ্দিন রুমিকে উপহার দেন।

নিশাপুর সফরের পরও এগিয়ে চলছিল বাহা ওয়ালাদের হজগামী কাফেলা। ৩০০ সদস্যেরও বেশি এ কাফেলা নানা শহর অতিক্রমের সময় তাতারদের হামলার খবর শোনা সত্ত্বেও এগিয়ে যেতেই থাকে। এ কাফেলা হজে যেতে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হলেও বালখে ফিরে আসার আশা ছেড়ে দিয়েছিল।

প্রখ্যাত মরমী কবি জামির একটি বই থেকে জানা যায়, অনেক দীর্ঘ পথ ভ্রমণ শেষে বাহা ওয়ালাদের কাফেলা পৌঁছে বাগদাদে। এ সময় একদল জনতা প্রশ্ন করছিল, ইনারা কারা ও কোন্ গোত্রের, কোথা হতে আসছেন ও যাচ্ছেন কোথায়? শিশু রুমি উত্তরে আরবী ভাষাতেই বললেন, আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, যাচ্ছি আল্লাহর দিকে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই। এ কথাটি শেইখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দির কানে গেল। ইরাকে থাকলেও তিনি ছিলেন ইরানের যানজ'ন অঞ্চলের ইরানি। তিনি আরবিতে বললেন, এ কাফেলা নিশ্চয়ই বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ বাল্‌খির কাফেলা। সোহরাওয়ার্দি বাহা ওয়ালাদকে স্বাগত জানাতে আসেন। সোহরাওয়ার্দি উট থেকে নেমে বাহা ওয়ালাদের হাঁটুতে চুমু দেন এবং তাকে নিজের খানক্বায় আসতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বাহা ওয়ালাদ মাদ্রাসায় থাকাকে প্রাধান্য দেন ও সঙ্গীদের নিয়ে মাদ্রাসাতেই ওঠেন।  সোহরাওয়ার্দি বাগদাদে সমবেত নানা দেশ বা অঞ্চলের মুসাফির, স্থানীয় জনগণ, হজযাত্রী ও খোরাসান থেকে আসা সুফিদের সমাবেশে ওয়াজ-নসিহত করতে বাহা ওয়ালাদকে অনুরোধ করেন। বালখ্ থেকে আসার পথে নানা শহরে যাত্রা-বিরতি করলেও নানা অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে ওয়াজ-নসিহতের মেজাজ ছিল না তার। কিন্তু বাগদাদে বক্তৃতা করার প্রস্তাবে তিনি খুবই খুশি হন।

বলা হয় বাগদাদে বাহা ওয়ালাদের ওয়াজের মজলিশে বাগদাদের তৎকালীন খলিফাও শরিক হন। অল্প সময়ের মধ্যেই বাহা ওয়ালাদের ওয়াজের মজলিশ বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে সাড়া জাগায়। এ সময় বাগদাদের নেতৃস্থানীয় সুফি বা আলেম ছিলেন সোহরাওয়ার্দি। তিনি বাহা ওয়ালাদকে রুম অঞ্চলে যাবার পরামর্শ দেন। সে যুগে রুম ছিল সালযুক বংশের এক শাসকের শাসনাধীন ও ফার্সি ভাষা আর সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল কেন্দ্র।  বাগদাদে অবস্থান বাহা ওয়ালাদ ও তার পরিবারের জন্য কঠিন হওয়ায় আবারও যাত্রা শুরু করেন তিনি। তার কাফেলার হিজরত শুরুর পর প্রথম বছরেই ইরাকি ও খোরাসানিদের জন্য হজ করা ছিল অসম্ভব। দৃশ্যত সিরিয়া অঞ্চলে থাকার দিনগুলোতে হজ করেন বাহা ওয়ালাদ। এ সময় সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ  সিরিয়ায় ও অন্য একটি অঞ্চলে ছিলেন। হজব্রত পালনের পর তিনি আবারও শহর থেকে শহরে সফর শুরু করেন এবং ওয়াজ করতে এশিয়া মাইনরের পূর্বাঞ্চলে যান। এ অঞ্চলের জনগণ ফার্সি ভাষা জানতেন বলে সেখানে বাহা ওয়ালাদের ওয়াজের মজলিশ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ