অক্টোবর ০২, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

গত কয়েক পর্বে আমরা জেনেছি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের প্রখ্যাত ইরানি আলেম, আরেফ, বক্তা ও কবি মাওলানা রুমির বাবা বাহা ওয়ালাদ নানা অঞ্চল ও দূরদেশ ভ্রমণ করে ধর্ম প্রচার করতেন। নানা কারণে এক সময় তিনি বালখ্‌ থেকে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। বাহাওয়ালাদ পরিবার-পরিজন ও বহু শিষ্য নিয়ে হজ পালনের উদ্দেশ্যে বালখ্ থেকে বের হন এবং এক পর্যায়ে খোরাসানের নিশাপুরে পৌঁছেন। নিশাপুরে স্বল্প যাত্রা বিরতির পর তিনি কাফেলা নিয়ে বাগদাদে আসেন ও সেখানে সসম্মানে কিছুকাল থাকার পর সিরিয়া অঞ্চলে আসেন। এরপর বাহা ওয়ালাদ সপরিবারে এশিয়া মাইনরের পূর্বাঞ্চলে আসেন। এ অঞ্চলের জনগণ ফার্সি ভাষা জানতো বলে সেখানে তার ওয়াজ বা ধর্মীয় বক্তৃতা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

সুলতানুল ওলামা নামে খ্যাত বাহা ওয়ালাদ ছোটখাট ও দীর্ঘ নানা সফরে এশিয়া মাইনরের নানা শহর ভ্রমণের পর সপরিবারে ল'রান্দেহ শহরে পৌঁছেন এবং এখানে বসবাস শুরু করেন। এ শহরটি বর্তমানে তুরস্কে ফারামান নামে পরিচিত। মুহাজির ও মুসাফির অবস্থায় বহু বছর কাটানোর পর ল'রান্দেহ শহরে আসার পর বাহা ওয়ালাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করা ও ইসলাম প্রচারের জন্য এ শহরই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।

ল'রান্দেহ শহরটির শাসক ছিলেন সালযুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের অনুগত। তিনি এ শহরে বাহা ওয়ালাদের প্রবেশের সুবাদে এখানে তার নামে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেন। এ শহরটি ছিল বেশ সুন্দর ও এখানে পাওয়া যেত পর্যাপ্ত পানি। বাইজান্টাইন রোমানদের ক্ষমতার কিছু স্মৃতি-চিহ্ন ও এমনকি প্রাচীন গ্রীক শাসনামলের কিছু নিদর্শন এ শহরের বাজার ও বসতিগুলোতে দেখা যেত। ক্রুসেডাররা বার বার মুসলমানদের এই শহরে হামলা করেছিল। বাহা ওয়ালাদের নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির খুব যত্ন নেয়া হত। এ ছাড়াও এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে বাহা ওয়ালাদ এই শহরের সঙ্গে নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে নেন যে তিনি কৌনিয়ায় সফরের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন যদিও কৌনিয়া ছিল সালযুক সুলতানের রাজধানী ও সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাই তাকে সেখানে সফর করার আমন্ত্রণ জানান। 

ল'রান্দেহ শহরে বেশ কয়েক বছর থাকেন বাহা ওয়ালাদ। এ সময় তার ছেলে জালালউদ্দিন রুমিও যৌবনে উপনীত হন। এখানকার ওয়াজ-মাহফিল ও ক্লাস খুব জমজমাট হওয়ায় তা উপভোগ করতেন বাবা ও ছেলে।

অবশেষে রুমের সালযুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের ব্যাপক অনুরোধের প্রেক্ষাপটে সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ কৌনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হন। সুলতান লারান্দেহ ও তার আশপাশের অনেক অঞ্চলে বাহা ওয়ালাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কথা শুনেছিলেন। ফলে তিনি খোরাসানের এই প্রখ্যাত শিক্ষক, মুফতি ও বক্তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। কৌনিয়া ছিল সে সময়কার বালখ্‌ , মার্ভ, হেরাত ও নিশাপুরের মতই জ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির এক বড় কেন্দ্র। বৃদ্ধ বয়সে সফর করাটা যন্ত্রণাদায়ক হওয়া সত্ত্বেও মাওলানা বাহা ওয়ালাদ সুলতানের দাওয়াত সানন্দেই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে যুবক রুমিও এমন অবস্থায় বাবাকে একাকী ছেড়ে দিতে পারছিলেন না। ইরান থেকে হিজরতের সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমা শেষ পর্যায়ে  বাহা ওয়ালাদ যুবক পুত্র রুমিসহ সপরিবারে রুমের সালযুক শাসকদের রাজধানী কৌনিয়াতে আসেন হিজরি ৬২৬ সনের দিকে। বাহা ওয়ালাদ ও তার পরিবারকে এখানে ব্যাপক উষ্ণ গণ-সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাওয়ারেজমশাহ জালালউদ্দিনকে পরাস্ত করার গৌরবের অধিকারী সালযুক সুলতান নিজেই বাহা ওয়ালাদ ও তার পরিবারকে সম্বর্ধনা জানাতে এগিয়ে আসেন। তিনি বাহা ওয়ালাদের হাতে মুরিদের মত চুমু খান। 

কৌনিয়ার বাজারের নানা পেশার মানুষ ও আশপাশের ধার্মিক মানুষেরা শহরের বেশ বাইরে এসে বাহা ওয়ালাদকে সম্বর্ধনা জানান। এমন একজন নামকরা ধর্মগুরু ও বক্তা এ অঞ্চলে আসায় স্থানীয় অসৎ মোড়লরা সৎ পথে আসবেন বলে তারা আশাবাদী ও খুশি হন। এ অঞ্চলের আলেম ও ইসলামী আইনবিদদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব থাকলেও একজন প্রবীণ আলেম এখানে আসায় তাদের বিরোধের নিরপেক্ষ সুরাহা হবে বলে তারাও আশাবাদী এবং খুশি হন।

কৌনিয়ায় বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের আগমন উপলক্ষে সালযুক সুলতানের পক্ষ থেকে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এক উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ও আলেমরাও এ উৎসবে যোগ দেন।

বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ বাগদাদের মত কৌনিয়াতেও একটি মাদ্রাসাকে বসবাসের জন্য বেছে নেন। এ শহরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও আলেমদের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও তিনি অভিজাত ব্যক্তিদের কোনো ভবনে বা রাজকীয় কোনো ভবনে প্রবেশ করেননি। ফলে অভিজাত ও সাধারণ জনগণসহ সব শ্রেণীর জনগণের মধ্যে বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে যায়। সুলতানের এক উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাধর কর্মকর্তা আমির বদরুদ্দিন সুলতানুল ওলামার জন্য একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। তার পুত্র মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি বালখীও এখানেই পড়াশুনা করতে থাকেন।

সেই যুগে সালযুক সুলতানদের রাজধানী কৌনিয়াও ছিল ফার্সিভাষী  কবি, লেখক ও পণ্ডিতদের লালন-কেন্দ্র। সরকারী ভাষাও ছিল ফার্সি। কেবল বাগদাদের খলিফার সঙ্গে যোগাযোগ ও মিশর ও সিরিয়ার গভর্নরদের সঙ্গে লিখিত যোগাযোগের সময় ছাড়া আরবি ব্যবহার করা হত না। রাজ-দরবার ও আদালতের ভাষাও ছিল ফার্সি। আলেম সমাজ, সুফি সমাজ, কবি ও ইতিহাস লেখকরাও ফার্সিতে কথা বলতেন ও এ ভাষায় লিখতেন। কৌনিয়া শহরের বেশিরভাগ অধিবাসীর ভাষাই ছিল ফার্সি।

কৌনিয়ায় বাহা ওয়ালাদের আগমন উপলক্ষে নির্মিত মাদ্রাসা এই মহান আলেমের উপস্থিতি ও বসবাসের সুবাদে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব শ্রেণীর মানুষের যোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে পড়ে। আর প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বাহা ওয়ালাদ ও তার পরিবারের প্রতি তাদের ভালবাসা আর শ্রদ্ধার কথা জানাতে থাকে।

বৃদ্ধ বাহা ওয়ালাদের ক্লাসগুলো আলেম, ফক্বিহ ও সুফি ছাড়াও উপস্থিত সব শ্রেণীর মানুষকে মুগ্ধ করত। তিনি যেসব ভালো কাজের আদেশ দিতেন ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে বলতেন সবাই তা সানন্দে মেনে নিত। খোদাপ্রেম ও আল্লাহর মর্যাদা সম্পর্কে তিনি যা বলতেন তা দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে খুবই হৃদয়গ্রাহী ও চির-পরিচিত মনের কথা বলে মনে হত। খুবই বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বাহা ওয়ালাদ কৌনিয়ার মাদ্রাসাস্থ নিজ বাসভবনে খুবই ক্ষীণ গলায় বক্তব্য রাখতেন, কিন্তু শুনতে খুব অসুবিধা হলেও অনুরাগী দর্শক-শ্রোতারা তা শুনে আনন্দ ও আবেগে আত্মহারা হয়ে যেত। তার সেইসব ভাষণ ছিল উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রাণ-জাগানো চেতনায় ভরপুর। জ্ঞানের অনন্য আলো ছড়ানো এ ধরনের বক্তব্য দিতে দিতেই ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে বাহা-ওয়ালাদের প্রাণ-প্রদীপ। অবশেষে তিনি ৬২৮ হিজরিতে ৮৩ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। কৌনিয়ার জনগণ অশ্রু-সজল নয়নে ও খুবই ব্যথিত চিত্তে এই মহান আলেমকে শেষ বিদায় জানায়। সুলতানের পক্ষ থেকে এক সপ্তার জন্য রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। কৌনিয়ার আলেম সমাজ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই শোকে শরিক হয়ে ইরানের খোরাসানের এই বিখ্যাত বক্তা ও ধর্ম প্রচারকের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।  স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বাহা ওয়ালাদের কবরকে অনুরাগীদের জন্য আকর্ষণীয় জিয়ারত কেন্দ্রে পরিণত করেন। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ