অক্টোবর ১৩, ২০২০ ২২:০০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা কাশানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও বাগিচা বগে ফিন নিয়ে কথা বলেছিলাম।  ফিন বাগিচার ভেতরে রয়েছে দেহ মন জুড়ানো শীতল একটি চমৎকার ঝর্ণা। এই ঝর্ণাটির নামও বাগিচার সঙ্গে মিল রেখেই রাখা হয়েছে ফীন। ফীন ঝর্ণাটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রবাহিত হয়ে বর্তমানেও তার প্রবহমান ধারা অব্যাহত রেখেছে। চমৎকার এই ফিন বাগিচা এবং ফিন ঝর্নার পাশাপাশি ঐতিহাসিক গ্রাম অবিয়নে নিয়েও কথা হয়েছে।

আজকের আসরে আমরা যাবো ইস্ফাহানের আরেকটি শহর খনসরের দিকে। খনসর অঞ্চলটি প্রাকৃতিক লীলাবৈচিত্র্যময় বলে খুবই আকর্ষণীয় । এখানে জন্ম নিয়েছে বহু জ্ঞানী-গুণী-বিজ্ঞানী, ফকীহ, ডাক্তার, কবি-সাহিত্যিক। পার্বত্য এই খনসর শহরটির দৈর্ঘ আট শ বিরানব্বুই বর্গকিলোমিটার। এর উচচতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দু' হাজার দুই শ'পঞ্চাশ মিটার । ইস্ফাহানের ঠিক উত্তর-পশ্চিম দিকে এই শহরটি অবস্থিত। খনসর নদীর তীরে ক্বেবলা ও গুলিস্তান পাহাড়ের উপত্যকা জুড়ে কেন্দ্রীয় শহরটি অবস্থিত। অনেক বেশী উচচতার কারণে এই শহরের আবহাওয়া শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং গ্রীষ্মকালে নাতিশীতোষ্ণ থাকে। এ কারণে অবকাশ যাপনের জন্যে এ অঞ্চলটি বেশ উপযোগী।

ইস্ফাহান শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে এক শ ষাট কিলোমিটারের মতো দূরে গেলে খনসর শহরের দেখা মিলবে। ইরানের কেন্দ্রিয় মরুভূমি থেকে খুব বেশি দূরে নয় শহরটি। উঁচু উঁচু পর্বতের পাদদেশে এবং বহতা নদী আর ঝর্ণার পাশে অবস্থিত হবার কারণে এখানকার আবহাওয়া আরো বেশী উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। খনসর চারণভূমি ইস্ফাহান প্রদেশের অন্যতম একটি চারণভূমি হিসেবে পরিগণিত। এখানে কৃষিজমি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাগ-বাগিচা এবং ফল-ফলাদির বাগান। উইলিয়ম জ্যাক্স খনসর শহর দেখার পর বলেছেন,খনসারের কথা মনে পড়লেই আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে টিলাগুচছ-ঝর্ণাধারা-নদীপ্রবাহ আর ফল-ফলাদির বৃক্ষসহ বিভিন্ন বাগ-বাগিচাপূর্ণ সবুজ একটি এলাকা। শহরটি বেশ সুন্দর এবং দেখার মতো। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে সঙ্কীর্ণ প্রণালীর পাশে এটি অবস্থিত। "আসলে প্রচুর পানি থাকার কারণেই এই শহরে সবুজের সমারোহপূর্ণ বাগ-বাগিচা গড়ে উঠেছে।

খনসরকে বরং বাগিচার শহর বলাই উত্তম। এতো বেশী বাগান এখানে যে, শীতকাল ছাড়া এই শহরের ঘর-বাড়ি তো দেখাই যায় না। কারণ শীতে গাছপালা পাতাশূন্য হয়ে যায়। ফলে চারদিকের ঘর-বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রীষ্মকালে গাছগাছালী সবুজ পাতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় বলে চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজই দেখা যায় , ঘরবাড়ি আর দেখা যায় না। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য কেবল শহরকে ঘিরেই নয় বরং শহরের আশপাশ জুড়েও রয়েছে পর্যটকদের জন্যে আকর্ষণীয় বহু স্পট। পার্বত্য গুলিস্তান নামে এখানে একটা সুন্দর স্পট আছে দেখার মতো। যদিও এটি মূল শহর থেকে প্রায় পণেরো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পার্বত্য গুলিস্তান এর প্রায় সমগ্র এলাকা জুড়েই শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। গ্রামীণ এই অঞ্চলটিতে প্রচুর গাযাঙ্গাবিন রয়েছে। গাযাঙ্গাবিন একধরনের গাছ। এই গাছ থেকে একপ্রকার আঠালো পদার্থ নির্গত হয় যা দিয়ে ইরানে 'গায' নামক এক শ্রেণীর মিষ্টি তৈরি করা হয়।

গাযাঙ্গাবিন ছাড়াও এখানে রয়েছে বুনো পেঁয়াজ। এছাড়া এখানে রয়েছে বিচিত্র জাতের লালাফুল। সব মিলিয়ে এখানকার মনোরম পরিবেশ যে-কোনো দর্শককেই আকর্ষণ করে। খনসর শহরের প্রাকৃতিক অবস্থা, এখানকার সবুজ চারণভূমি বিশেষ করে শহরের দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় চারণভূমি জুড়ে বুনো গাছ-পালা আর ফুল থাকার কারণে এখানে মৌমাছির আনাগোণা ব্যাপক। এ কারণে এ অঞ্চলটি মধুচাষের একটা প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। খনসা'রের লোকজনের বহুদিনের পুরোনো পেশা হলো এই মধুচাষ। বর্তমানে এখানে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ শ' টন মধু উৎপাদিত হয়। এখানকার বেশিরভাগ লোকজন মধু চাষ করেই তাদের জীবীকা নির্বাহ করে ।

এতোক্ষণ আপনারা খনসর শহরের ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে পরিচিত হলেন, এবার এই শহরের ইতিহাসের সাথে খানিকটা পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। ইতিহাসের দিক থেকেও এই শহরটি বেশ সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী খনসর শহরটির প্রাচীন কাঠামো বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং ঐ শহরের একটি অংশ কৃষিক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। রাশিয়ার বিশিষ্ট পর্যটক এবং গবেষক চারিকফ তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে বর্তমান খনসর শহরটিকে চারশ' বছর আগের বলে উল্লেখ করেছেন । সাফাভি আমলে এই শহরটি ছিল শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র। খনসারের ওপর সাফাভি বাদশাদের সুদৃষ্টি ছিল । আর সে কারণেই এখানে হস্তশিল্প সামগ্রীসহ বিভিন্ন শিল্প-কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। খনসারে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন রয়েছে। যেমন এখানে রয়েছে মসজিদ , নবীবংশের উত্তরপুরুষদের মাযারসহ আরো বহু সমাধি।

খনসরের ঐতিহাসিক বহু নিদর্শনের মধ্যে মসজিদ এবং নবীবংশের উত্তরপুরুষদের মাযারসহ আরো বহু সমাধির কথা বলছিলাম। এগুলোর অধিকাংশই সাফাভি আমলের নিদর্শন। এসবের মধ্যে পীর খনসর মাযার বিখ্যাত। পীর খনসর বাবাপীর নামেই বেশী পরিচিত ছিলেন। তিনি অনেক বড়ো বুযুর্গ ও আবেদ ছিলেন। খনসর জামে মসজিদটিও এখানকার প্রাচীন আরেকটি স্থাপনা। এই মসজিদটি শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিন শ' বছর আগে এটি তৈরি করা হয়। মসজিদের ভেতর-বাইরের কারুকাজ খুবই আকর্ষণীয়। খনসরি একটি যৌগিক শব্দ। এই নামটির মধ্যে দুটি শব্দ রয়েছে। একটি হলো খন অপরটি সর। ফার্সি ভাষায় খন মানে হলো ফোয়ারা আর সর মানে হলো প্রচুর। এরকম নাম থেকে সহজেই বোঝা যায় যে এই শহরে রয়েছে প্রচুর ঝরনা, ফোয়ারা তথা পানির উৎস।

পানির এই সহজলভ্যতার কারণেই এখানে গড়ে উঠেছে বিচিত্র বাগ-বাগিচা। আর সবুজ বাগ-বাগিচা যে একটি শহরকে উপভোগ্য করে তুলবে, বেহেশতি আমেজে ভরে তুলবে চারদিক তাতে আর সন্দেহ কী!#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ