অক্টোবর ১৫, ২০২০ ১৬:১০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা কাশানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও বাগিচার শহর খনসরে গিয়েছিলাম। সেখানকার বেশ কিছু স্থাপনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। খনসরি একটি যৌগিক শব্দ। এই নামটির মধ্যে দুটি শব্দ রয়েছে। একটি হলো খন অপরটি সর। ফার্সি ভাষায় খন মানে হলো ফোয়ারা আর সর মানে হলো প্রচুর। এরকম নাম থেকে সহজেই বোঝা যায় যে এই শহরে রয়েছে প্রচুর ঝরনা, ফোয়ারা তথা পানির উৎস।

ইস্ফাহানের ঠিক উত্তর-পশ্চিম দিকে এই শহরটি অবস্থিত। খনসার নদীর তীরে ক্বেবলা ও গুলিস্তান পাহাড়ের উপত্যকা জুড়ে কেন্দ্রীয় শহরটি অবস্থিত। অনেক বেশী উচচতার কারণে এই শহরের আবহাওয়া শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং গ্রীষ্মকালে নাতিশীতোষ্ণ থাকে । এ কারণে অবকাশ যাপনের জন্যে এ অঞ্চলটি বেশ উপযোগী। উঁচু উঁচু পর্বতের পাদদেশে এবং বহতা নদী আর ঝর্ণার পাশে অবস্থিত হবার কারণে এখানকার আবহাওয়া আরো বেশী উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। খনসার চারণভূমি ইস্ফাহান প্রদেশের অন্যতম একটি চারণভূমি হিসেবে পরিগণিত । এখানে কৃষিজমি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাগ-বাগিচা এবং ফল-ফলাদির বাগান। খনসরের উল্লেখযোগ্য কিছু স্থাপনা ও দর্শনীয় বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সুন্দর সুন্দর বাগান, ঐতিহ্যবাহী কিছু ঘর, ভজগুন টিউলিপ এবং বাগ-বাগিচাময় অলিগলি। খনসরের পানির প্রধান উৎস হলো প্রাকৃতিক ফোয়ারা।

উইলিয়ম জ্যাক্স খনসার শহর দেখার পর বলেছেন,খনসারের কথা মনে পড়লেই আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে টিলাগুচছ-ঝর্ণাধারা-নদীপ্রবাহ আর ফল-ফলাদির বৃক্ষসহ বিভিন্ন বাগ-বাগিচাপূর্ণ সবুজ একটি এলাকা । শহরটি বেশ সুন্দর এবং দেখার মতো। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে সঙ্কীর্ণ প্রণালীর পাশে এটি অবস্থিত । "ফার্সিতে এই পার্কের নাম ছারচেশমে পার্ক। এই পার্কের উত্তর পূর্বে একজন বিখ্যাত আরেফের মাজার অবস্থিত। এই আরেফের নাম শেখ আদনান। বাবাপীর নামেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত। এই পীর ছিলেন হিজরি ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত একজন আরেফ বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তবে এখন যে স্থাপনাটি দেখতে পাওয়া যায় সেটি সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্যশৈলির নিদর্শন। এই কবরস্থানে অবশ্য শেখ আদনানের সমাধি ছাড়াও আরও ছয় জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কবরও রয়েছে।

পবিত্র এই সমাধি ছাড়াও এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক 'চহর রহ' মসজিদ। এই মসজিদটির আরেক নাম হলো খনসার জামে মসজিদ। খনসার জামে মসজিদটিও এখানকার প্রাচীন আরেকটি স্থাপনা। এই মসজিদটি শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিন শ' বছর আগে এটি তৈরি করা হয়। মসজিদের ভেতর-বাইরের কারুকাজ খুবই আকর্ষণীয়। এই মসজিদটির আয়তন তিন হাজার বর্গমিটারের মতো। চকের যেসব কারুকাজ করা হয়েছে এই মসজিদের ভেতর-বাইরে তা এক কথায় অসাধারণ। মসজিদটিতে কোনো গম্বুজ নেই তবে ছোট্ট একটি মিনার রয়েছে সুন্দর শিল্পকর্ম খচিত। মিনারটির উচ্চতা মাত্র তিন মিটার। মসজিদের প্রধান ফটকে কাঠের তৈরি একটি দরোজা আছে। উত্তর দিকের ওই গেইটের কাঠের কপাটটিতে ঐতিহাসিক কারুকাজ রয়েছে। এমনকি মসজিদটির মিম্বারেও শৈল্পিক কারুকাজের নৈপুণ্য লক্ষনীয়।

খনসারে গ্রীষ্মকালে গাছগাছালী সবুজ পাতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় বলে চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজই দেখা যায়, ঘরবাড়ি আর দেখা যায় না। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য কেবল শহরকে ঘিরেই নয় বরং শহরের আশপাশ জুড়েও রয়েছে পর্যটকদের জন্যে আকর্ষণীয় বহু স্পট। পার্বত্য গুলিস্তান নামে এখানে একটা সুন্দর স্পট আছে দেখার মতো। যদিও এটি মূল শহর থেকে প্রায় পণেরো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ছারচেশমে পার্কের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। প্রায় পণর হেক্টর জায়গাজুড়ে খনসার পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে উঠেছে পার্কটি। খনসার শহর থেকে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই পার্ক অসম্ভব সুন্দর। এ কারণেই খনসারের এই পার্বত্য উপত্যকা ভ্রমণকোরীদের কাছে খুবই প্রিয় একটি এলাকা।

খনসার পার্কে রয়েছে অসংখ্য ফোয়ারা। এগুলোর মধ্যে মারজাঙ্গুশ ফোয়ারা, শোতোরখুন ফোয়ারা এবং পীর ফোয়ারা বেশ উল্লেখযোগ্য। ফোয়ারার পাশাপাশি বিশাল বিশাল বৃক্ষময় জঙ্গলও এখানকার পরিবেশকে উপভোগ্য করে তুলেছে। বিশেষ করে ভ্রমণকারীরা দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে এসে এখানে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ে তখন এইসব ছায়াবীথিকার নীচের সবুজ পরিবেশে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়। অতিথি এবং ভ্রমণকারীদের জন্য নিকুঞ্জেরও ব্যবস্থা রয়েছে এই পার্কের ভেতরে। খনসার পার্কের ফোয়ারাগুলো উদ্যানের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি খনসারের কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদাও মিটিয়ে থাকে। এইসব ফোয়ারা থেকে অন্তত এগারোটি প্রবাহমান ধারার সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছে।

বলছিলাম খনসারের প্রাকৃতিক পরিবেশ অতিথি ও ভ্রমণকারীদের কাছে খুবই প্রিয়। ইরানের দূর দূরান্তের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন ভ্রমণপ্রিয় মানুষেরা এখানে বছরজুড়েই বেড়াতে আসে তেমনি দেশের বাইরে থেকেও বহু ভ্রমণকারী আসে এখানে ঘুরতে। এখানে যারা বেড়াতে আসে তারা গোলেস্তানকুহ এলাকায় যেতে ভুল করে না। সংরক্ষিত এই বিশাল এলাকায় ব্যতিক্রমধর্মী টিউলিপ বাগান রয়েছে। খনসার শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গোলেস্তানকুহ এলাকাটির আবহাওয়াও যথেষ্ট উপভোগ্য। বসন্তের সময় পুরো এলাকাটি এই টিউলিপ ফুলের বৈচিত্র্যে ভরে যায়। অধোমুখি টিউলিপ, বিশেজর টিউলিপ, অগ্নিমুখি টিউলিপ এবং পার্বত্য টিউলিপ-এই কয়জাতের টিউলিপ এখানে দেখতে পাওয়া যায়।

খনসারের উপহার সামগ্রির মধ্যে রয়েছে মধু, আখরোট, আমন্ড বাদাম, জার্দালু এবং উন্নতমানের গাজ মিষ্টি। এখানকার হস্তশিল্প সামগ্রিও বিখ্যাত। গালিচা বোণা, মৃৎশিল্প ইত্যাদিও এখানকার মানুষের ঐতিহ্যবাহী পেশা। সারুক নামের এক ধরনের কার্পেট এখানকার নিজস্ব উৎপাদনগুলোর অন্যতম। খনসার শহরের ভিস্ত গ্রামের বাসিন্দারা এই সারুক কার্পেট বুণে থাকে। আমেরিকার হান্টিংটন মিউজিয়ামে এই সারুক কার্পেটের নমুনা সংরক্ষিত আছে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ