অক্টোবর ২৪, ২০২০ ১৭:১৫ Asia/Dhaka

আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের প্রথম পর্বের অর্জন এবং দ্বিতীয় পর্বের সংঘর্ষ নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা অভিযানের দ্বিতীয় পর্বের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করব।

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের প্রথম পর্বে হাজার হাজার ইরানি যোদ্ধা দেশের সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘ কারুন নদী পার হয়ে ২৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ইরাকি সেনাদের পেছনে চলে যান। অভিযানের এ পর্যায়ের অন্যতম কঠিন কাজ ছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খরস্রোতা এই নদীর উপর পাঁচটি অস্থায়ী সেতু স্থাপন করা। ওই অভিযানের ছয় দিন পর ১৯৮২ সালের ৬ মে রাত সাড়ে ১১টায় দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। এই পর্যায়ে ইরানি যোদ্ধারা আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়ক ধরে ইরাক সীমান্তের দিকে এগিয়ে যান। এ সময় ইরাকি যোদ্ধারা কিছুটা পিছু হটে যায়। পশ্চাদপসরণের সময় ইরাকিদের কয়েকটি ট্যাংক গভীর খাদে পড়ে যায়। 

ইরানি সৈন্যরা কারুন নদী পার হয়ে যাওয়ার কারণে খোররামশাহরে মোতায়েন ইরাকি বাহিনী হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়; কারণ তারা আশা করেছিল নদীতে স্থায়ী যে সেতু রয়েছে ইরানি যোদ্ধারা সেটি পার হবে, এ কারণে ওই সেতুর দুই পাশে তারা প্রচুর সেনা মোতায়েন করে রেখেছিল। প্রথম পর্বের অভিযানের অর্জন নিয়ে ইরানি সেনা কমান্ডাররা আলোচনায় বসে দ্বিতীয় পর্বের অভিযান চূড়ান্ত করেন এবং সে অনুযায়ী ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের আন্তর্জাতিক সীমান্তে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। এ অবস্থায় আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী তিন দিক দিয়ে বিপদ অনুভব করে। এরমধ্যে ইরাকি সেনাবাহিনীর ৫ ও ৬ নম্বর ডিভিশনের পেছনের অংশ ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়ে যায়। এ ছাড়া, ইরাকের বসরা নগরী রক্ষা করার জন্য দেশটির সেনাবাহিনী তেমন কোনো ব্যবস্থা না রাখায় সীমান্তবর্তী ওই নগরীটিও ইরানি যোদ্ধাদের হামলার হুমকির মুখে পড়ে। 

এ অবস্থায় ইরাকি সেনাবাহিনী সীমান্তের এপারে দখলীকৃত ইরানি নগরী খোররামশাহর দখলে রাখবে নাকি সীমান্তের ওপারে নিজেদের বসরা নগরী রক্ষায় আত্মনিয়োগ করবে তা নিয়ে দোটানায় পড়ে যায়। যদি তারা সাদ্দামের নির্দেশ অনুযায়ী খোররামশাহরের ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চায় তাহলে সেখানে প্রচণ্ড মার খাওয়ার পাশাপাশি বসরা নগরীর নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অন্যদিকে তারা যদি নিজেদের বসরা নগরী রক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তাদেরকে খোররামশাহর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহার করতে হবে; তা না হলে প্রচুর সেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে মারা পড়বে। ইরাকি সেনা কমান্ডাররা ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় পথ বেছে নেয় এবং ৫ ও ৬ নম্বর ডিভিশনকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেয়। 

 

১৯৮২ সালের ৮ মে ভোররাতে ইরাকি সেনাবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তারা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানসহ বহু সমরাস্ত্র ফেলে চলে যায় এবং তাদের বহু সেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।  ইরানের কুদস ফোর্স এ সময় ইরাকি বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে এবং আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কের পাশাপাশি জাফির ও হোভেইজে এলাকা এবং হামিদ ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করে। ইরাকি সেনারা পশ্চাদপসরণের সময় এতটা তাড়াহুড়ো করে যে, তাদের অনেক সেনা পিছু হটার সিদ্ধান্তের কথা জানতেই পারেনি এবং মধ্যরাতে ঘুমিয়ে থাকার কারণে তারা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।

অভিযানের এ পর্যায় সম্পর্কে ইরানের সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রহিম সাফাভি বলেন: “আমরা এক ঝটকায় আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কে এবং দ্বিতীয় ঝটকায় সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাই। কাজেই ইরাকি শত্রুরা ধরে নিয়েছিল যে, আমাদের তৃতীয় ঝটকায় তাদের ইরাকে ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা দ্রুত সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।” আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে জেনারেল সাফাভি আরো বলেন: “ইরাকি শত্রুরা আমাদেরকে তাদের বসরা নগরীর দিকে অগ্রসরমান দেখতে পায়। এ অবস্থায় তারা ইরানের দখলীকৃত অংশে নিজেদের উপস্থিতি ধরে রাখার আর কোনো কারণ খুঁজে পায় না। ফলে তারা ইরাকের বসরা নগরী রক্ষা করতে পিছু হটে যায়।”

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায় শেষে  ইরানের খোররামশাহর দখলে রাখার ইরাকি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইরানি যোদ্ধাদের অকুতোভয় মনোবল ও দেশকে শত্রুমুক্ত করার অদম্য স্পৃহার ফলে এই অভিযান শতভাগ সফল হয়।  এই অভিযানের প্রথম লক্ষ্য ছিল ইরানের ভূমিতে ইরাকি সেনাদের উপস্থিতির অবসান ঘটানো এবং তাদেরকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল খোররামশাহরের ওপর অবরোধ আরো সঙ্কুচিত করে শত্রু সেনাদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়া। তৃতীয় লক্ষ্য ছিল হোভেইজে এলাকা থেকে ইরাকের ৫ নম্বর মেকানিক্যাল ডিভিশন ও ৬ নম্বর আর্টিলারি ডিভিশনকে সরে যেতে বাধ্য করা। অভিযানের চতুর্থ লক্ষ্য ছিল আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়ক শত্রুমুক্ত করা। 

দ্বিতীয় পর্যায়ের এই অভিযানের বিশাল সাফল্যে ইরানের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা আগ্রাসী বাহিনীর দখলমুক্ত হয়।  শত শত ইরাকি সেনা হতাহত হওয়ার পাশাপাশি তাদের ৯ হাজার ৭৫ জন সেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।  বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর বহু ইরাকি সেনা ইউনিট ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ইরানি সেনা কমান্ডাররা জরুরি বৈঠকে বসেন। দ্বিতীয় পর্বের অভিযানের খুঁটিনাটি বিষয় পর্যালোচনার পাশাপাশি অভিযানের পরবর্তী পর্বের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা ছিল এ বৈঠকের উদ্দেশ্য।
বৈঠকে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র নাসর ঘাঁটির কমান্ডার শহীদ হাসান বাকেরি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী খোররামশাহর থেকে শত্রু সেনাদের পিছু হটে যাওয়ার খবর দেন। 

আইআরজিসি’র ফাতহ ঘাঁটির কমান্ডার গোলামআলী রাশিদ জানান, আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী এখন দু’দেশের সীমান্তবর্তী শহর ‘শালামচে’ রক্ষা করার জন্য জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ইরানি যোদ্ধারা যাতে ওই শহরের দিকে অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য তারা সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সেনা কমান্ডাররা অভিযানের তৃতীয় পর্ব দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। আইআরজিসি’র প্রধান কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি বলেন, ইরাকি বাহিনী এত দ্রুত রণে ভঙ্গ দেয়ার পাত্র নয়। তারা প্রচারণা যুদ্ধে এগিয়ে থাকার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, কাজেই আমাদের সাফল্য ধরে রাখার জন্য অচিরেই আমাদেরকে তৃতীয় দফা অভিযান চালাতে হবে। 
ওদিকে ইরাকি সেনারা পিছু হটে যাওয়ার পর শালামচে শহরে অবস্থান নেয় যাতে খোররামশাহরের পেছনের অংশ ধরে রাখার পাশাপাশি বসরা শহরকে রক্ষা করা যায়। # 


পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ