নভেম্বর ০৯, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবন নিয়ে কথা বলব।

গত কয়েক পর্বে আমরা যা জেনেছি তা হল ধর্মপ্রাণ মনসুর হাল্লাজ যৌবনে নানা অঞ্চল ও দেশ সফর করে এবং কয়েকজন বড় আলেম ও সুফি-সাধক বা আরেফের সান্নিধ্যে থেকে বিরল প্রতিভা ও যোগ্যতা দেখিয়েছিলেন। ইরানি এই আরেফ তিনবার হজব্রত পালনের পর এক পর্যায়ে খোদাপ্রেমের প্রতীকী বক্তব্য প্রচার শুরু করেন। তার সমর্থক ও  শত্রুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছিল। জনগণ তাঁকে মহান সংস্কারক ও ত্রাণকর্তা বলে ভাবতে থাকায় বাগদাদের আলেমরা ও শাসকগোষ্ঠীর অনেকেই তার সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করতে থাকেন। অবশেষে বাগদাদের আলেম ও শাসকগোষ্ঠী মনসুর হাল্লাজ সম্পর্কে নানা অভিযোগ বা অপবাদ তুলে ধরে তাকে কারাগারে ঢোকান। জীবনের শেষ আটটি বছর তিনি কারাগারেই কাটান। তার বিচার চলাকালের এই দীর্ঘ সময়ে বাগদাদের সুফিরা ইরানি এই আরেফের প্রতি কোনো অনুরাগ দেখাননি।

বিচারের সর্বশেষ পর্যায়ে মনসুর হাল্লাজকে কাফের ঘোষণা দিয়ে তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় বাগদাদের সুফিদের মধ্য থেকে কেবল আবুল আব্বাস তাকে সমর্থন করেন। এই সমর্থনের কারণেই পরবর্তীকালে সুফি সমাজের অনেকেরই অনেক অভিযোগ বা অপবাদের দায় থেকে মুক্ত হয়েছিলেন মনসুর হাল্লাজ। আট বছরের আটক অবস্থার মধ্যে আব্বাসীয় খলিফা মোক্তাদির ও তার মা এবং খলিফার ঘনিষ্ঠ একজন কর্মকর্তা মনসুর হাল্লাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সত্ত্বেও বাগদাদের আলেম সমাজের নির্দেশের বিপরীতে তার পক্ষে কিছুই করতে পারেননি। কোনো এক ঘটনার প্রেক্ষাপটে মনসুর হাল্লাজের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং তৎকালীন মন্ত্রী হামিদ বিন আব্বাসের জোরালো চাপের মুখে তার বিচার ও হত্যার ঘটনা সম্পন্ন হয়।

বলা হয় দিনেভার অঞ্চলের এক ব্যক্তির কাছে মনসুর হাল্লাজের একটি অদ্ভুত চিঠি দেখা গেছে। ওই চিঠির ওপর লেখা ছিল: রহমান রহিমের পক্ষ থেকে অমুকের পুত্র অমুকের কাছে। চিঠিটি বাগদাদে মনসুর হাল্লাজকে দেখানো হলে তিনি স্বীকার করেন যে এটা তারই লেখা। তিনি এর মাধ্যমে প্রভুত্ব বা রবুবিয়াতের দাবিদার হয়েছেন কিনা?-এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, না, এটা এমন এক বিষয় যাতে সুফিদের কেউ কেউ বিশ্বাস রাখেন। মন্ত্রী হামিদ বিন আব্বাস এ বিষয়ে লিখিতভাবে তার বিশ্বাস তুলে ধরতে মনসুর হাল্লাজকে নির্দেশ দেন। ফলে তিনি লিখিত উত্তর দেন। এই লিখিত বক্তব্য আবু মোহাম্মাদ জারিরি ও আবুবকর শিবলির কাছে পাঠানো হয়। তারা প্রথমে এ বিষয় থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা সফল হয়নি। আবু মোহাম্মাদ জারিরিকে মনসুর হাল্লাজের বক্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: এই ব্যক্তি কাফের ও তাকে অবশ্যই হত্যা করা উচিত। শিবলি কিছুটা নমনীয় উত্তর দিয়ে বলেন, যার বিশ্বাস এ ধরনের তাকে এমন বিশ্বাস থেকে দূরে রাখা উচিত।

মনসুর হাল্লাজের বিশ্বাস বা আকিদা যখন ফোক্বাহা বা ইসলামী আইনবিদদের কাছে তুলে ধরা হয় তখন তারা সবাই এ ধরনের বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেন। কেবল সুফিবাদী আলেম ইবনে আতা অদামি হাল্লাজের ওই বক্তব্য সমর্থন করে লিখিতভাবে জানান যে যাদের বিশ্বাস এমন নয় তারাই বরং কাফের! মন্ত্রী হামিদ বিন আব্বাস এ অবস্থায় ইবনে আতাকে দরবারে তলব করে তার সঙ্গে কড়া সুরে কথা বলেন। ইবনে আতাও মন্ত্রীর সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলেন। ফলে মন্ত্রীর নির্দেশে ইবনে আতা নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। মনসুর হাল্লাজকে একঘেয়ে ও দীর্ঘ-সময়ের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত থাকে। হামিদ বিন আব্বাস প্রতিদিন তাকে একবার নিজ মজলিসে ডেকে এসে আলেম ও বিচারকদের মুখোমুখি করতেন এবং আবারও তাকে কারাগারে ফেরত পাঠাতেন। দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্য ছিল মনসুর হাল্লাজ-এর কথা থেকে এমন কোনো নোক্তা বা পয়েন্ট বের করা যার অজুহাতে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়।

জাদু-দেখানো ও প্রভু হওয়ার দাবির মত নানা অপবাদ আরোপের ভিত্তিতেই মনসুর হাল্লাজকে আটক করে আদালতে আনা হয়েছিল এবং এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে নাস্তিক বলে অভিহিত করা হত। বলা হত তিনি বলতেন: আনাল হক্ব তথা আমিই খোদা। এ ধরনের কথার অস্তিত্ব ইরফান বা রহস্যময় খোদাপ্রেমের বক্তব্যে অতীতেও ছিল। এর মাধ্যমে ওয়াহদাতে অজুদ বা অস্তিত্বের একত্ব তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করা হত। আনাল হক্বের গভীর অর্থ হল আরেফদের দৃষ্টিতে সব সৃষ্টি বা অস্তিত্বেরই মূলে রয়েছেন মহান আল্লাহ এবং সব কিছুই আল্লাহরই প্রকাশ। এই হিসেবে মনসুর হাল্লাজ কোনো অবাস্তব ও অস্বাভাবিক কথা বলেননি। কিন্তু সেই যুগ বা সময়টা ছিল তার বিপক্ষে এবং তার বিরোধীরা এ ধরনের প্রতীকি কথাকেও সহ্য করতে পারছিল না। মনসুর হাল্লাজকে যতবারই বিচারের কাঠগড়ার আনা হত ততবারই তিনি এমনভাবে বক্তব্য রাখতেন যে তাতে সব সন্দেহ দূর হয়ে যেত। এ ছাড়াও তিনি বিচারের কাঠগড়ায় কলেমায়ে শাহাদাতাইন পাঠ করতেন এবং কারাগারে প্রায়ই নামাজ, রোজা, জিকর্‌, দোয়া ও তওবায় মশগুল থাকতেন।

মনসুর হাল্লাজ নিজের প্রভু হওয়ার কথিত দাবি ও ইমাম মাহদি হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করতেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আব্বাসীয় মন্ত্রী হামিদ বিন আব্বাস সে সময়কার আলেম ও বিচারকদের বাধ্য করেছিলেন মনসুর হাল্লাজকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে শাস্তি দেয়ার রায় দিতে!  বিচারকরা মনসুর হাল্লাজের বক্তব্যের প্রতীকি হওয়ার বিষয়টি বুঝতে না পারলেও রুজবাহান বাকলির মত পরবর্তী যুগের সুফি সাধকরা আধ্যাত্মিক আত্মহারা অবস্থার বিচিত্র বা অদ্ভুত উক্তির মধ্যে ওই একই বক্তব্য প্রয়োগ করেছেন।

মনসুর হাল্লাজের সর্বশেষ বিচারের দিনগুলোতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছিল নিষিদ্ধ বা খুবই কঠিন। এ সময় ইবনে আতা ও  শিরাজের যুবক সুফি-সাধক আবু আবদুল্লাহ খাফিফ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মনসুর হাল্লাজের অবস্থা সম্পর্কে খাফিফের বর্ণনা পরবর্তী যুগে সুফি-সাধকদের বইয়ে স্থান পায়।

মনসুর হাল্লাজ তার বিচারের সর্বশেষ পর্বে আত্মপক্ষ সমর্থনে সর্বোচ্চ জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম ও সুন্নি মাজহাবের প্রতি তার বিশ্বাসের কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তাকে হত্যার যে ফতোয়া দেয়া হয় তৎকালীন মন্ত্রী হামিদ বিন আব্বাসের প্রচেষ্টায় তাতে খলিফা নিজেও সায় দেন। ফলে খলিফার মাতা ও খলিফার রাজকীয় গৃহাধ্যক্ষ বা চেম্বারলেইনের বাধা সত্ত্বেও মনসুর হাল্লাজের ফাঁসি ঠেকানো যায়নি। ৩০৯ হিজরির ২৩ জিলহজ রহস্যময় এই আরেফের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগেই গোটা শহরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও ছদ্মবেশী গুপ্তচর মোতায়েন করা হয়। শহরের বেশিরভাগ মানুষ তখনও মনসুর হাল্লাজ-এর পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। #    

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।